1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বীর সন্তানদের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়

ডেস্ক রিপোর্ট : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

রাসি বিপ্লবের আগে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির হাতে গড়ে ওঠে সে দেশের গণমানুষের মৌলিক জাগরণের ভিত, যা ফরাসিদের ঐতিহাসিক বিপ্লবের পথে ধাবিত করে। সেদিনকার পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের বেলাতেও অনেকটা এমনই হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদী জাগরণ একদিকে বিকশিত হয়েছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাতাবরণে, অন্যদিকে জাতীয় বুদ্ধিভিত্তিক চেতনা বা আত্মাকে ক্ষুরধার করেছিলেন বাঙালি অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরা। ফলে তারা সামরিক ও ধর্মকেন্দ্রিক যূথবদ্ধ শাসকদের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের বেদনাদায়ক অনেক অধ্যায়ের একটি বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যা। এই নির্মমতার রূপকার ছিল পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহচর আলবদর, রাজাকার ও আলশামস বাহিনীর নেতারা যারা পরিকল্পিত পন্থায় নিধন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। কারণ তারা জানত, এসব অসাম্প্রদায়িক কীর্তিমান ব্যক্তিকে হত্যা করা হলে বাঙালি সমাজের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিপালন বিপন্ন হবে।

ব্রিটিশ ভারতের অবসানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতে। এরপর ১৯৫২ সালে ঘটে বাংলা ভাষার পরিপূর্ণ সংগ্রাম, যার ব্যাপকতা ভাষাভিত্তিক জাতীয় চেতনাকে সম্প্রসারিত করে। এই প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা রাখে ছাত্রসমাজ এবং সেই চেতনাকে শাণিত করে সেদিনকার শীর্ষ বুদ্ধিজীবী শ্রেণিÑ যারা কেউ ছিলেন অধ্যাপক, লেখক, সমাজচিন্তক, কবি, সাংবাদিক কিংবা চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার। তারা একদিকে যেমন পাকিস্তানের পূর্ব অংশের ওপর পশ্চিম অংশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবিচারের ব্যাখ্যা দান করেন, অন্যদিকে বাঙালির সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেন। এসব কারণেই মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে পাকিস্তানপন্থিদের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হন এই বুদ্ধিজীবীরা, ফলে তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিভিন্ন দলিলপত্র দেখে জানা গেছে, বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে, যার সঙ্গে কমপক্ষে ১০ জন সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তির যোগসাজশ ছিল। হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কর্নেল হেজাজি, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির ও ক্যাপ্টেন কাউয়ুম। এতে সম্মতি দান করেছিলেন পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি। বলা বাহুল্য, বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর নেতা ও সদস্যরা।

পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের দেশীয় অনুচররা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ১৯৭১ সালে। হত্যা করেছে ৩০ লাখ বাঙালি। এরা বাঙালি নারীদের যৌনদাসী বানিয়েছে, নিয়েছে নিজেদের ক্যাম্পে, পাচার করেছে সেনা ছাউনীতে। এসব নির্যাতিত নারীর বেশিরভাগকে দেশ স্বাধীনের পর উদ্ধার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষক সুজান ব্রাউনমিলার দীর্ঘ গবেষণার পর এই ভয়ংকর গণধর্ষণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর ‘হররস অব ইস্ট পাকিস্তান টার্নিং হোপ ইনটু ডিসপেয়ার’ শিরোনামের এক রিপোর্টে বেশ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : ওয়ান টেল দ্যাট ইজ ওয়াইডলি বিলিভড অ্যান্ড সিমস টু কাম ফ্রম মেনি ডিফারেন্ট সোর্সেস ইজ ওয়াইডলি বিলিভড অ্যান্ড সিমস টু কাম ফ্রম ম্যানি ডিফারেন্ট সোর্সেস ইজ দ্যাট ফাইভ হান্ড্রেড সিক্সটি থ্রি উইম্যান পিকড আপ বাই দ্য আর্মি ইন মার্চ অ্যান্ড এপ্রিল অ্যান্ড হেল্ড ইন মিলিটারি ব্রথেলস আর নট বিইং রিলিজড বিকজ দে আর প্রেগন্যান্ট বিয়ন্ড দ্য পয়েন্ট অ্যাট দে আর প্রেগন্যান্ট বিয়ন্ড দ্য পয়েন্ট অ্যাট হুইচ এবরশন্স আর পসিবল।

পাকিস্তানি মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা তার বইতে লিখেছেন, নিয়াজি সব সময় চাইতেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্বিচার ধর্ষণের মধ্য দিয়ে সে বাঙালি জাতির রক্তকে বদলে ফেলবে! মুক্তিযুদ্ধের পর জাতিসংঘের আমন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসক জিয়ফ্রি ডেভিস ঢাকায় এসে এসব নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী এই নারীদের সংখ্যা দুই থেকে চার লাখের মধ্যে।

হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আর জে রুমেলের মতে : ‘দে প্ল্যানড টু মার্ডার দ্যাট কান্ট্রিস বেঙ্গালি ইন্টেলেকচুয়াল, কালচারাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল এলিট। দে প্ল্যানড টু ইনডিস্ক্রিমিনেটলি মার্ডার হান্ড্রেডস অব থাউজ্যান্ডস অব ইটস হিন্দুস অ্যান্ড ড্রাইভ দ্য রেস্ট ইনটু ইন্ডিয়া। অ্যান্ড দে প্ল্যানড টু ডেস্ট্রয় ইটস ইকোনমিক বেজ টু ইনসিউর দ্যাট ইট উড বি সাবরডিনেট টু ওয়েস্ট পাকিস্তান ফর অ্যাট লিস্ট আ জেনারেশন টু কাম। দিস ডেসপিক্যাবল অ্যান্ড কাটথ্রোট প্ল্যান ওয়াজ আউটরাইট জেনোসাইড’। যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান সাংবাদিক ডেন কগিন একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের বরাত দিয়ে লিখেছেন : ‘উই ক্যান কিল এনিওয়ান ফর এনিথিং। উই আর একাউন্টেভবল টু নো ওয়ান’। দিস ইজ দ্য এরোগেন্স অব পাওয়ার। টাইম ম্যাগাজিনের মতে, ‘ইট ইজ দ্য মোস্ট ইনক্রেডিবল, ক্যালকুলেটেড থিং সিন্স দ্য ডেজ অব দ্য নাজিস ইন পোল্যান্ড’

স্মরণযোগ্য, অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকেই প্রতিটি রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হতে থাকে পাকিস্তান বাহিনী। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত অঞ্চলের বহু জায়গা পাকিস্তান বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বিলক্ষণ বুঝতে পারে, অচিরেই এই যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে। ঠিক এই সময়ে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৩ তারিখে, ভারতের পশ্চিম অংশে আকস্মিকভাবে পাকিস্তান বিমান বাহিনী আক্রমণ চালায়। এতে যুদ্ধ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেদিনই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। গঠিত হয় ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক কমান্ড’, যার নেতৃত্ব দেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এমনিতেই সুসংগঠিত মুক্তিবাহিনীর লাগাতার আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী পিছু হটছিল, তার মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে তারা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে। ঠিক এ সময়েই পরিকল্পনা আঁটা হয় শীর্ষ বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার। মুক্তিযুদ্ধের পর এসব শীর্ষ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা পাওয়া যায় সেদিনকার ‘গভর্নর হাউস’ যা আজকের বঙ্গভবনে। এই তালিকা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কতটা পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়েছে।

২৫-২৬ মার্চ ১৯৭১; অর্থাৎ গণহত্যা শুরুর সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শীর্ষ অধ্যাপককে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বিচার গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ চালায়। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন দার্শনিক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, লেখক, কবি, চিকিৎসকসহ সব শ্রেণির মানুষ। তবে শেষ আঘাতটি আসে যখন বাংলাদেশের মাটিতে তারা চূড়ান্ত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে।

বুদ্ধিজীবী হত্যার চূড়ান্ত পরিণতি আসে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের ঠিক আগে। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, তারা একমাত্র ঢাকা নগরীতেই দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে তুলে নেয় এবং নিষ্ঠুর পন্থায় হত্যা করে। ঢাকাতে হত্যার ব্যাপকতা অনেক বেশি থাকলেও দেশের জেলা সদরগুলোতেও চলে ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা। ঢাকার হত্যামিশনে নিযুক্ত অস্ত্রধারীরা গেস্টাপো কায়দায় বুদ্ধিজীবীদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে আনে। তাদের চোখ বেঁধে মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, মিরপুর, রাজারবাগের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। কারফিউ বহাল থাকায় লোকজন ঘরের বাইরে থাকেনি বলে হত্যাকারীদের সুবিধা হয়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে এসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় এবং রায়েরবাজার, মিরপুরের আলোকদি, কালাপানি, রাইনখোলা ইত্যাদি জায়গায় লাশ ফেলে রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তিবাহিনী যখন ঢাকা শহরে প্রবেশ করে তখন এদের লাশ দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন নালা-ডোবায়। প্রায় প্রত্যেকের হাত ও চোখ বাঁধা, শরীরের বিভিন্ন অংশে বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা এ রকম : শিক্ষাবিদ ৯৯১, সাংবাদিক ১৩, চিকিৎসক ৪৯, আইনজীবী ৪২, সাহিত্যিক ও শিল্পী ৯।

ঢাকা বা বড় শহরই কেবল নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই অগণিত বধ্যভূমিতে শুয়ে আছেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা; যারা প্রাণ দিয়েছেন, কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি। বাংলাদেশের জন্মে এদের অবদান অনস্বীকার্য। প্রখ্যাত লেখক ও কীর্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান হারিয়ে যান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ তার ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে তিনি যখন মিরপুরে যান।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় অতিক্রম করেছে। শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নতুনরা এসেছেন। অর্থনৈতিকভাবে প্রভূত এগিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বেশ উদ্বেগের সঙ্গেই লক্ষ করতে হচ্ছে, সমাজ পতনমুখী হচ্ছে; নৈতিকতার হাল ধরার সাহসী মানুষ, যোগ্য মানুষ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে! যে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে ১৯৭১ সফল হয়েছিল, দুর্ভাগ্য সেই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার পুনরাভিযান ঘটেছে! কালো দন্তনখর বের করে আগের মতো আবারও পুরোনো অন্ধকার এগিয়ে এসে জাতির মনোভূমি কলুষিত করছে, বাঙালি বিভাজিত হচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে মনুষ্যত্ব। এসব দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে : যে বুদ্ধিজীবীদের রক্তে এই মাটি রঞ্জিত, তারা কি এই অধঃপতনে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন না? প্রার্থনা করি, সময়ের দাবি পূরণ করতে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা গতানুগতিকতায় গা ভাসাবেন না, তারা সাহসী হবেন, সরব হবেন।

লেখক: হারুন হাবীব – বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।


সর্বশেষ - রাজনীতি