1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

তিস্তা মহাপরিকল্পনা : বাংলাদেশের গেম চেঞ্জার

নিজস্ব প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২২

৩৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। তবে ভারতের তরফ থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া না মেলায় অনেকটাই নিষ্ফল হয়েছে সে প্রচেষ্টা। তিস্তা নদীর উজানে খাল ও ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ভারত তিস্তার প্রায় সবটুকু পানিই প্রত্যাহার করে আসছে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে কৃষির প্রয়োজনীয় সেচে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পাহাড়ি ঢলের তোপের মুখে ভারত তার ব্যারেজগুলোর মুখ খুলে দেয়ায় সেখান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রতিবছরই বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ।

খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতিপ্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য। পাশাপাশি বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মাঝেও কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে তিস্তাকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনাসহ নদীকে ঘিরে নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা জানায় বেইজিং। চীনের এই আগ্রহে হঠাৎ করেই নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তিস্তা নদী।

ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী তিস্তা

তিস্তা নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। চীনের তিব্বত সীমান্তবর্তী ভারতের সিকিমে হিমালয়ের ৫ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত তিস্তা খাংগসে হিমবাহ থেকে নদীটির সৃষ্টি হয়েছে। সিকিমের পার্বত্য এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদীটি বাংলাদেশের নিলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়িতে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়। তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার, যার ১১৫ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত।

কয়েকশ বছর আগে তিস্তা নদী জলপাইগুড়ির দক্ষিণে করতোয়া, পুনর্ভবা ও আত্রাই নামে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা নদীতে মিশত। সম্ভবত এই তিনটি ধারার অনুষঙ্গেই ত্রি-স্রোতা নামটি এসেছিল, যেটি কালক্রমে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে উচ্চারিত হয় তিস্তা নামে।

১৭৮৭ সালের এক বিধ্বংসী বন্যার পর তিস্তা তার পুরোনো খাত পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মেশে। করতোয়া নদীর মাধ্যমে তিস্তার যে ধারাটি গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।

অর্ধশত বছরেও সুরাহা হয়নি তিস্তার পানি বণ্টন

তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা অনেক পুরোনো। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরপরই ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী, তিস্তার পানির ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ ও ৩৯ শতাংশ ভারতের প্রাপ্য ছিল। অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে সেই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৭ সালে এর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি হয়নি।

এরপর আবার ২০০৭ সালে এ ব্যাপারে একটি বৈঠক হয়। সেখানে তিস্তার ৮০ শতাংশ পানি দুই দেশের মধ্যে সমান সমান ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়েছিল।

এরপর ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসম্মতিতে শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যায় চুক্তি স্বাক্ষর।

এরপর ২০১৫ সালে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ও এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। সবশেষ গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরেও এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির তরফ থেকে কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি।

তিস্তার গলার কাঁটা ভারতের গজলডোবা বাঁধ

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ওদলাবাড়ি অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম গজলডোবা। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের এই গজলডোবায় ১৯৮৭ সালে তিস্তা বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ভারত সরকার।

প্রকল্পের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগে ১১ বছর। ১৯৯৮ সালে চালু করা হয় ৯২১ দশমিক ৫৩ মিটার দৈর্ঘ্যের ‘গজলডোবা ব্যারেজ’। বাঁধে মোট গেট রয়েছে ৪৫টি। এই বাঁধকে তিস্তার গলার কাঁটা হিসেবে অবহিত করা হয়। এই বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানির প্রায় পুরোটাই সরিয়ে নিচ্ছে উজানের দেশ ভারত।

সেই পানি মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার, মালদহ, জলপাইগুড়িসহ বিভিন্ন জেলায় কৃষিকাজে সরবরাহ করছে। এমনকি বিহারের মেচি নদী পর্যন্ত এ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে উজান-ভাটির দেশ বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কোনো অনুমতি পর্যন্ত নেয়া হয়নি।

তিস্তা ঘিরে চীনের মহাপরিকল্পনা

তিস্তা নদীকে ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে চীন। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

এরপর পাওয়ার চায়না নিজ উদ্যোগে তিস্তা নদীকে ঘিরে সমীক্ষা চালানোর পর এ ব্যাপারে একটি মহাপরিকল্পনা উপস্থাপন করে।

তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট নামের তাদের এই মহাপরিকল্পনায় আছে নদীর দুই তীর ধরে ১০২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের স্থায়ী বাঁধ ও মহাসড়ক নির্মাণ। ভারত সীমান্ত থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্রে তিস্তার মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এই বাঁধ। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ড্রেজিং করে তিস্তা নদীকে আরও গভীর করা হবে।

তিনটি অংশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা

প্রকল্পের তিনটি অংশ থাকছে। আপার রিচ, মিডল রিচ ও লোয়ার রিচ। লালমনিরহাটের তিস্তা ব্যারেজ থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ব্রিজ পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার অংশকে বলা হচ্ছে আপার রিচ হিসেবে। মহিপুর ব্রিজ থেকে রংপুরের কাউনিয়া ব্রিজ পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার অংশকে বলা হচ্ছে মিডল রিচ। আর কাউনিয়া ব্রিজ থেকে গাইবান্ধার ফুলছড়িতে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার অংশকে বলা হচ্ছে লোয়ার রিচ।

এ প্রকল্পের মূল ধারণাটি হলো, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভাটি থেকে তিস্তা- ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল পর্যন্ত নদীর বর্তমান প্রস্থ কমিয়ে ৭০০ থেকে ১০০০ মিটারে সীমাবদ্ধ করা হবে। এর মধ্যে তিস্তা ব্যারেজ থেকে কাউনিয়া ব্রিজ পর্যন্ত নদীর প্রস্থ রাখা হবে সাতশ মিটারের মধ্যে। আর কাউনিয়া ব্রিজ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অংশের প্রস্থ রাখা হবে এক কিলোমিটার। নদীটির গভীরতাও বাড়িয়ে ১০ মিটার করা হবে। প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, নদীশাসনের মাধ্যমে তিস্তা নদীকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পানি বহনক্ষমতা বাড়ানো, নদীর দুই পাড়ে বিদ্যমান বাঁধের মেরামত, নদীর দুই পাড়ে মোট ১০২ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ, ৫০টি গ্রোয়েন স্থাপন ও ড্রেজিংয়ের মাটি ভরাট করে নদীর দুই পাড়ে ১৭০ বর্গকিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবিত তিস্তা নদীর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবে এর খরচ ধরা হয়েছে ৯৮৩ মিলিয়ন ডলার। যার অধিকাংশ অর্থায়ন করবে চীন।

তিস্তা প্রকল্পে বদলে যাবে তিস্তাপারের মানুষের জীবন

তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি প্রাপ্যতা বৃদ্ধি, জমি উদ্ধার, নৌচলাচল বৃদ্ধিসহ তিস্তাপাড়ে কৃষি অঞ্চল, শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্প, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা হবে এবং তিস্তাপারের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা হবে। সরাসরি উপকৃত হবে ৫টি জেলার প্রায় ১ কোটি মানুষ।

চিলমারী বন্দর থেকে ডালিয়ায় তিস্তা বাঁধ অংশে তিনটি নৌ-টার্মিনাল তৈরি করা হবে। নদীর দুই পাড়ে বাঁধের ওপর ফোর লেন হাইওয়ে তৈরি করা হবে, যার মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে।

মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ ছাড়া বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে সেচ খাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এতে প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমি এই সেচ ব্যবস্থার আওতায় আসবে।

ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও মাছচাষ প্রকল্প পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া নদীর মধ্যে কয়েকটি ব্যারেজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করা হবে।


সর্বশেষ - রাজনীতি