করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে আর্থিক খাতের সেবার পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি সুবিধা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলা রাখার ও সেবা দেওয়ার পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি সেবা কার্যক্রম চালু করেছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোও সীমিত আকারে চালু করেছে তাদের কার্যক্রম।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ চলমান রয়েছে। ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চলে প্রথম দফা। এরপর একই ধরনের বিধিনিষেধ ১২ ও ১৩ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো হয়। ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু হয় তৃতীয় পর্যায়ে আরও কঠোর বিধিনিষেধ। ইতোমধ্যে তা আরও বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে। ৫ থেকে ১৩ এপ্রিল আর্থিক সেবা প্রায় স্বাভাবিকভাবে চললে ১৫ এপ্রিল থেকে অনেক সীমিত করা হয়। বুধবার পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত আর্থিক সেবার আওতা আরও বাড়ানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশাসন বিভাগ থেকে গত মঙ্গলবার রাতে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার থেকে ২৪টি বিভাগ খোলা থাকবে। আগে খোলা থাকত ৭টি বিভাগ। একই সঙ্গে সেবার আওতায় নতুন করে ডকুমেন্ট এগেইনস্ট পেমেন্ট (পিএডি), সরকারি বিভিন্ন ট্রেজারি বিল ও বন্ড বেচাকেনারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে সীমিত সংখ্যক জনবল দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল ১০টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এসব বিভাগ খোলা থাকবে। তবে লেনদেন চলবে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ সবগুলো শাখা অফিস খোলা থাকবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লেনদেনে সহায়তা প্রদান, সরকারি লেনদেন নিষ্পত্তি করা, আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পন্ন করা, রাজস্ব চালান জমা নেওয়াসহ সরকারি বন্ড, বিল ও সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের মুনাফা প্রদানের জন্য এসব বিভাগ থেকে সেবা দেওয়া হবে।
ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং, ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট, পেমেন্ট সিস্টেমস, ইনফরমেশন সিস্টেমস ডেভেলপমেন্ট এন্ড সাপোর্ট, আইসিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ম্যানেজমেন্ট, কমন সার্ভিস ১ ও ২, নিরাপত্তা বিভাগ, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি. অফসাইট সুপারভিশন, আইসিটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার, সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট, ইন্টারনাল অডিট, ব্যাংক পরিদর্শনের ৪টি বিভাগ, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি ও কাস্টমার সার্ভিস, ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার, পরিসংখ্যান, কৃষিঋণ, এসএমই ও স্পেশাল প্রোগ্রাম বিভাগ, এক্সপেন্ডিচার ১ ও ২, মানবসম্পদ ১ ও ২, নিরাপত্তা বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট শাখা ও ডেস্কগুলো সীমিত সংখ্যক জনবল দ্বারা খোলা থাকবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা অফিসের ব্যাংকিং, ক্লিয়ারিং হাউজ, ক্যাশ কাউন্টার, পিএডি, সিকিউরিটিজ ও ভল্ট খোলা থাকবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০টি শাখা অফিস রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-রাজধানীর মতিঝিল ও সদরঘাট। এছাড়া ময়মনসিংহ, বগুড়া, খুলনা, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী অফিস। এসব শাখা থেকে গ্রাহকরা জরুরি প্রয়োজনে সরকারি বন্ড ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে পারবেন। সরকারের বিভিন্ন ধরনের রাজস্বের চালান জমা দেওয়া যাবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকা জমা ও তুলতে পারবে। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যক্রমও সম্পন্ন করা যাবে।
১৫ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক সীমিত পরিসরে খোলা থাকলেও নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলার জারি করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোসহ ঢাকায় একটি ও ঢাকার বাইরে একটি শাখা সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত খোলা রাখতে হবে। এ সময়ে গ্রাহকের হিসাবের মেয়াদ পূর্তিতে অর্থ তোলা ঋণের কিস্তি জমা নেওয়াসহ জরুরি আর্থিক কর্মকাণ্ড চালানো যাবে।
এই সময়ে সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই ৩ ঘণ্টা সব গ্রাহক ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারবেন। তবে ব্যাংকের সব শাখা খোলা থাকবে না। সীমিত আকারে কিছু শাখা খোলা থাকবে। লেনদেন পরবর্তী অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত খোলা রাখা যাবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত মঙ্গলবার একটি সার্কুলার জারি করে করেছে। বিধিনিষেধ চলাকালে সব ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় বা প্রধান শাখাসহ সব বৈদেশিক বাণিজ্য শাখা ও জেলা সদরে অবস্থিত ব্যাংকের প্রধান শাখা খোলা রাখতে হবে। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতি দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি শাখা খোলা রাখতে হবে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে প্রতিটি ব্যাংকের একটি শাখা বৃহস্পতিবার, রোববার ও মঙ্গলবার খোলা রাখতে হবে। সীমিত আকারে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগও খোলা রাখা যাবে।
সমুদ্র. বিমান ও স্থলবন্দরে অবস্থিত ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও বুথ সার্বক্ষণিক খোলা রাখার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসন, বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আলোচ্য সময়ে গ্রাহকদের হিসাবে সব ধরনের অর্থ জমা, টাকা তোলা, ডিমান্ড ড্রাফট, পে-অর্ডার ইস্যু ও জমা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে ট্রেজারি চালান গ্রহণ, সরকারের বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের আওতায় প্রদত্ত ভাতা প্রদান, অনুদান বিতরণ, বৈদেশিক রেমিটেন্সের অর্থ পরিশোধ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃশাখা অর্থ স্থানান্তর, প্রবাসী বা এনআরবি বন্ড, বিভিন্ন জাতীয় সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্তিতে নগদায়ন, কুপনের অর্থ পরিশোধ, গ্যাস, পানি বিদ্যুৎ, টেলিফোন বিলসহ বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি সেবার বিল গ্রহণসহ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক চালু রাখা বিভিন্ন পেমেন্ট সিস্টেমস ক্লিয়ারিং ব্যবস্থার আওতাধীন অন্যান্য লেনদেনে সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এই নির্দেশের ফলে গ্রাহকরা ব্যাংকের সব ধরনের চেক লেনদেন করতে পারবেন। এ জন্য ক্লিয়ারিং হাউজ ব্যবস্থাও চালু থাকবে।
এটিএম সেবা সার্বক্ষণিক চালু থাকবে। গ্রাহকদের সুবিধার্থে বুথগুলোতে পর্যাপ্ত টাকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে অনলাইন লেনদেন সব সময় চালু রাখতে হবে। এটিএম বুথ থেকে দিনে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা তোলা যাবে। আগে তোলা যেত ৫০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে টাকার পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমেও ওই পরিমাণ টাকা স্থানান্তর করা যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে পরিচালিত মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চালু রাখতে হবে। একই সঙ্গে এজেন্টদের কাছ থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ঘোষিত সময়সীমা হচ্ছে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। ফলে ওই সময়ে এজেন্টদের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু থাকবে। তবে অ্যাপস বা মোবাইল ফোন সেটে এই সেবা সার্বক্ষণিকভাবে চালু থাকবে।
আলোচ্য সময়ে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত আকারে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এর মধ্যে অনলাইনে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম তদারকি, স্বল্প আয়ের মানুষের আয়বর্ধক কার্যক্রম, মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।
শেয়ারবাজারে লেনদেন : যেহেতু সীমিত পরিসরে ব্যাংক খোলা থাকছে সে কারণে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু থাকবে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত লেনদেন চলবে।