কয়েক দিন আগে বিশ্বব্যাংক তার সর্বশেষ ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস’ প্রকাশ করেছে। এই প্রকাশনায় আশঙ্কা করা হয়েছে যে ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৭ শতাংশে নেমে যাবে। অথচ ছয় মাস আগেই আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি আশা করেছিল যে এ বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ৩ শতাংশ। হতাশাজনক প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণের পেছনে উঁচু হারের মূল্যস্ফীতি, বাড়তি সুদের হার, পড়ন্ত বিনিয়োগের হার এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইনের ভঙ্গুরতাকে কারণ হিসেবে দায়ী করেছে এই বিশ্ব সংস্থা। বিশ্বব্যাংকের আশঙ্কা, মূল্যস্ফীতির হার যদি হঠাৎ আরো বেড়ে যায়, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যদি তাদের নীতি সুদহার আরো বাড়িয়ে দেয়, কভিড-১৯-এর নয়া কোনো ধরন ফের যদি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় যদি ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়, তাহলে বিশ্বমন্দার তীব্রতা আরো বাড়বে। আর এটা যদি ঘটে, তাহলে এক দশকের মধ্যে দুবার বিশ্বমন্দার প্রাদুর্ভাবের এই নজির বিগত ৮০ বছরের মধ্যে নতুন করে দেখা দেবে।
এই প্রতিবেদনে ২০২৩-এ বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৭ শতাংশ হলেও ২০২৪ সালে তা ২.৭ শতাংশে উন্নীত হবে। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে প্রবৃদ্ধির এই তীব্র পতন পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকেই টালমাটাল করে ফেলবে। এর ফলে উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির ৯৫ শতাংশ আক্রান্ত হবে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির ৭০ শতাংশ এই আক্রমণের শিকার হবে। আরো আশঙ্কা করা হচ্ছে যে আগামী দুই বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি হবে গড়ে ২.৮ শতাংশ। উল্লেখ্য, ২০১০-২০১৯ সময়ের গড় হিসাব থেকে এই সংখ্যা ১ শতাংশ কম। আর সাবসাহারা আফ্রিকায় এই সময়ে মাথাপিছু আয় বাড়বে মাত্র ১.২ শতাংশ হারে। ফলে এই অঞ্চলে দারিদ্র্য পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি হবে।
এই প্রেক্ষাপটেই বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস বলেছেন যে বিকাশমান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নপ্রচেষ্টা তীব্র সংকটে পড়তে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেছেন, কয়েক বছর ধরেই এসব দেশের প্রবৃদ্ধি কমছে। এদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। বিনিয়োগ সক্ষমতা কমছে। উন্নত দেশগুলোর উঁচু সরকারি ঋণ ও সুদের হারের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব পুঁজি তাদের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ পড়ে যাওয়ার কারণে এরই মধ্যে অবহেলিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য, অবকাঠামো এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত খাতগুলো আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অঞ্চলভেদে প্রবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি দেখা যাক। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২৩ সালে মাত্র ০.৫ শতাংশ হারে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০২২ সালে এদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির হার হবে ০.৫ শতাংশ। ছয় মাস আগের দেওয়া পূর্বাভাসের চেয়ে এই হার ১.৯ শতাংশ কম। ইউরো এলাকায় চলতি বছরের প্রবৃদ্ধি হবেই না। শূন্য প্রবৃদ্ধির এই হার আগের পূর্বাভাসের চেয়ে ০.৯ শতাংশ কম। চীনেও প্রবৃদ্ধি কমবে। চীন ছাড়াই ২০২৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ২.৭ শতাংশ। ২০২২ সালে যা ছিল ৩.৮ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই অধোগতির পেছনে কাজ করবে পড়ন্ত বহির্চাহিদা, উঁচু হারের মূল্যস্ফীতি, মুদ্রামানের অবমূল্যায়ন, সংকুচিত আর্থিক পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ কারণ। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জিডিপির পরিমাণ আগের প্রক্ষেপিত পরিমাণের চেয়ে অন্তত ৬ শতাংশ কম হবে। ২০২২-২০২৪ সময়কালে এসব দেশের বিনিয়োগ গড়ে ৩.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। দুই দশক আগের চেয়ে এই হার হবে অর্ধেকেরও কম। আর তাই এই প্রতিবেদনে দেশগুলো যাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সচেষ্ট হয় সেই প্রত্যাশা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে যে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগের হার না বাড়াতে পারলে এসব দেশে উৎপাদনশীলতা ও বাণিজ্য প্রসারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর ক্ষুদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার হার অন্যান্য দেশের হারের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হবে।
২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫.৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা সামান্য বেড়ে হবে ৫.৮ শতাংশ। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ছয় মাস আগেও বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতি বাড়বে ৬ শতাংশের বেশি হারে। এখন বলছে, এই হার হবে ৫.২ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা হবে ৬.২ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগ অবশ্যি বলছে, চলতি অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৫ শতাংশ। অবশ্যি আগের প্রক্ষেপিত হারের চেয়ে এই হার প্রায় ১ শতাংশ কম। ভারত অবশ্য এ বছর ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করবে বলে এডিবি আশা করছে। এডিবির হিসাবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬.৬ শতাংশ হারে বাড়বে।
নিশ্চয় বিশ্বমন্দার ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধাক্কা মারবে। মনে রাখা চাই আমাদের অর্থনীতি এখন অনেকটাই ‘গ্লোবালাইজড’। তাই সারা বিশ্বে মন্দার লু হাওয়া বইলে বাংলাদেশ তার বাইরে থাকবে কী করে? অবশ্যি ২০০৮-০৯ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট ভালোভাবেই সামাল দিতে পেরেছিল। শক্তিশালী কৃষি, প্রবাস আয় এবং রপ্তানিমুখী শিল্পসেবা আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পুরো এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ বছর বছর তার প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে এবং দারিদ্র্য নিরসনসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের শক্ত ভিত্তিভূমি স্থাপন করেছে। তা সত্ত্বেও ২০২০ সালের কভিড-১৯ এবং ২০২২ সালের ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সেই গতিময়তা খানিকটা হলেও মন্থর করেছে। তা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ ভালো বৈ মন্দ করেনি।
কিন্তু এখন যে বিশ্বমন্দার চোখ রাঙানি দেখতে পাচ্ছি তা মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশকে সমস্যাগুলোর ধরন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরূপণ করে খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি গ্রহণ করতে হবে। এই সময়টায় একদিকে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে বিশেষ বিশেষ ব্যাংকে তারল্য সমস্যার মতো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ডলারসংকট এ দুটি সমস্যার পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। তাই ডলার সমস্যা সমাধান করাটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবন চলাকে খুবই কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমাদের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের মতো। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের মতো। যদিও গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমেছে, তবু কাঙ্ক্ষিত পর্যায় থেকে তা অনেকটাই বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক তাই আগের লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে এসে মূল্যস্ফীতিকে ৭.৫ শতাংশে আটকে রাখার পরিকল্পনা করেছে। এই হারও কম নয়। বিশেষ করে কম ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য এই হার খুবই পীড়াদায়ক। কারণ মানুষের আয়-রোজগার এবং সঞ্চয় এই হারে বাড়ানো যাচ্ছে না।
একই সঙ্গে এ কথাটি মনে রাখতে হবে যে মূল্যস্ফীতির পেছনে বাড়ন্ত চাহিদার পাশাপাশি সরবরাহ ঘাটতি কাজ করে। সরবরাহ ঘাটতির সঙ্গে আমদানি করা পণ্যের দামের প্রশ্নটি সরাসরি জড়িত। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম এমনিতেই প্রায় এক-চতুর্থাংশ বেড়ে গেছে। আর আমরা যে পরিমাণ আমদানি করি তার ৮০ শতাংশ সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে রপ্তানির জন্য যে কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় তার বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। তা ছাড়া আমাদের কৃষি এবং দেশের মানুষের ভোগের জন্য যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণ করা হয় তাদের জন্যও যে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি লাগে তা-ও আমদানি করতে হয়। সুতরাং আমাদের উৎপাদনব্যবস্থা সচল রাখতে এবং বেশ কিছু খাদ্য সরবরাহের জন্য (যেমন—ভোজ্য তেল, গম) আমদানির প্রয়োজন হয়। আর সে কারণেই আমাদের আগেভাগে ডলারসংকট মোকাবেলা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এই ডলারসংকট মোকাবেলার জন্য প্রথমেই ডলার ও টাকার বিনিময় হার নিয়ে যে অসংগতি ও বিভ্রান্তি আছে তা দূর করা দরকার। প্রবাসীরা মোটামুটি ভালো রেটেই ডলার বিক্রি করছেন। তাই নতুন বছরের প্রবাস আয়ের প্রবাহ বেশ ভালো। নতুন বছরের প্রথম ১০ দিনে ৭৬৪ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে প্রবাস আয় এসেছে। এই অঙ্ক গত বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত আসা অঙ্কের চেয়ে প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি। আশা করছি এই ধারা অক্ষুণ্ন থাকবে। চলমান অর্থবছরের প্রথমার্ধে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৬ শতাংশ হারে। যদি রপ্তানিকারকরা তাঁদের আয় করা ডলারের দাম প্রবাসীদের আয়ের কাছাকাছি পান, তাহলে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির হার আরো বাড়বে। একই সঙ্গে রপ্তানি আয়ের বিনিময় হারে যদি আমদানির জন্য কেনা ডলারের বিনিময় হার স্থির করা যায়, তাহলে আরো বেশি রপ্তানি আয়ের ডলার দেশে ঢুকবে। মোদ্দাকথা সব ডলারের বিনিময় হার বাজারনির্ভর করার যে প্রচেষ্টা বাংলাদেশ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বিদেশি মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা দ্রুতই ফিরে আসবে।
স্পর্শকাতর এই বাজারকে তার মতো করে চলতে দিলে এর প্রতি অংশীজনের আস্থা বাড়বে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। পাশাপাশি আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে আরো বেশি বাজেট সহায়তা, জলবায়ু সহায়ক সহায়তা এবং অন্যান্য সমর্থন সংগ্রহের জন্য স্মার্ট অর্থনৈতিক কূটনীতি অব্যাহত রাখতে হবে। আগে প্রতিশ্রুত বিদেশি সহায়তানির্ভর প্রকল্পগুলোর উপযুক্ত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে গতি এনে আরো বেশি বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার দিকেও নজর দিতে হবে। অপেক্ষাকৃত বেশি আয় করেন এমন প্রবাসীদের বাংলাদেশের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সরকারি ও বিশেষ বন্ড ডিজিটালি বিকিকিনির সুযোগ করে দিলে নিশ্চয় বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। সে জন্য এসবের সুদ বা বিনিয়োগের লভ্যাংশের হার বিদেশের ওই সব আর্থিক পণ্যের চেয়ে আকর্ষণীয় করার জন্য যেসব নীতি সংস্কারের দরকার আছে তা নির্দ্বিধায় করতে হবে। এসবের মূল বিনিয়োগ ও লভ্যাংশ সহজেই প্রত্যাবাসনের সুযোগও করে দিতে হবে। শুধু প্রবাহ বাড়িয়ে নয়, প্রতিটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন যেন দক্ষতার সঙ্গে করা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এভাবেই বিদেশি মুদ্রার ব্যবহারে কৃচ্ছ্র নীতি পরিচালনা করলে বিদেশি মুদ্রার তহবিলে কম টান পড়বে।
মূল্যস্ফীতি কমানোর আরেকটি উপায় চাহিদায় কাটছাঁট করা। সে জন্য ভোক্তা ও উদ্যোক্তাদের হাতে কম তারল্য রাখার প্রবণতাকে উৎসাহিত করা জরুরি। এটা সম্ভব ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে তার পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে। সে জন্যই পৃথিবীর সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে। আমরাও কয়েকবার বাড়িয়েছি। কিন্তু ব্যাংকগুলো যদি এর ওপর যথেষ্ট স্প্রেড না রাখতে পারে, তাহলে এই নীতি কাজে আসে না। যেকোনো কারণেই হোক এই নীতিটি আমরা দক্ষতার সঙ্গে পরিপালন করে উঠতে পারছি না। সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষি, এসএমই এবং রপ্তানি সহায়ক পুনরর্থায়নের কর্মসূচি চালু করেছে। উদ্দেশ্য এসব উৎপাদনশীল খাতে যেন কম সুদে তহবিল সংগ্রহ করে ব্যাংকগুলো উৎপাদনশীল খাতে বেশি করে বিনিয়োগ করে। এসব কর্মসূচি ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারলে নিশ্চয় উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।
একই সঙ্গে ভোক্তাঋণসহ অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা খানিকটা আরো উঁচু করার যে মৌখিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে তাকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে আনুষ্ঠানিক করার প্রয়োজন রয়েছে। সিলিং একেবারে তুলে না দিতে পারলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এভাবে সুদের হার বাড়ানোর সুযোগ নিশ্চয় করা সম্ভব। এটা না করা গেলে আমানতের সুদের হারও মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি করা যাচ্ছে না। অথচ আমানতকারীদের সামান্য অংশই ঋণ নেন। বেশির ভাগই মূলত সঞ্চয়কারী। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই টানাপড়েনের সময় সঞ্চয়কারীদের আয়-রোজগার আরেকটু বাড়ানোর সুযোগ তাঁরা চাইতেই পারেন। বাজার কিন্তু কতিপয়ের জন্য নয়। বাজার সবার। এ কথাটি আর্থিক বাজারের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। কিছু বড় উদ্যোক্তাকে সুবিধা দিতে গিয়ে অনেক বেশি সঞ্চয়কারীকে বঞ্চিত করাটা সঠিক নীতি হতে পারে না।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তার হাই পাওয়ার্ড রিজার্ভ মানির পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া এই ঋণের মুদ্রা দ্রুত হাতবদল ঘটে। শেষ পর্যন্ত এই মুদ্রার কয়েক গুণ প্রসারের কারণে মূল্যস্ফীতির আগুনকে আরো উসকে দেয়। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চিরচেনা পরীক্ষিত পথেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাঁটা উচিত। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ ব্যাংক শেষ পর্যন্ত সেই পথেই হাঁটবে।
তা ছাড়া আমাদের প্রকৃত অর্থনীতি, তথা কৃষি, রপ্তানি ও আমদানি-বিকল্প স্বল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে বাড়তি অর্থ প্রবাহের দিকে আগের চেয়ে আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। অন্যদিকে চলমান অর্থনৈতিক সংকটে আয়-রোজগার কমে যাওয়া পরিবারগুলোর জন্য কম দামে খোলা বাজারে খাদ্য বিক্রিসহ বাড়তি সামাজিক সুরক্ষা সমর্থন দিতে হবে রাজস্ব নীতিনির্ধারকদের। একই সঙ্গে কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে দেওয়া ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এতে করে বাজেট ঘাটতি যদি খানিকটা বাড়েও তবু সামাজিক শান্তির খাতিরে এটা করতে হবে। প্রচলিত সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থাও একই কারণে সচল রাখতে হবে সরকারকে।
ধাবমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে সঠিকভাবে মোকাবেলার জন্য আমাদের স্বল্প মেয়াদের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবন ও জীবিকা এবং প্রকৃতির প্রাণ রক্ষার জন্য উন্নয়নকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সবুজ করার জন্য মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিকে উল্লিখিত লক্ষ্য পূরণে সুসমন্বিত ও গণমুখী করতে হবে। সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল অভিজ্ঞতা ও অর্জন। তাকে সম্বল করেই এই সংকটকালে এগিয়ে যেতে হবে সব অংশীজনকে হাতে হাত ধরে। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পথকে আরো প্রশস্ত ও কণ্টকমুক্ত করার কাজকেই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ঠাঁই করে দিতে হবে আমাদের নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে।
লেখক : ড. আতিউর রহমান – বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।