1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বিশ্ব বিস্ময়ের চূড়ান্তে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন

সুভাষ হিকমত : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১

অর্থনীতি, বাণিজ্য ও সামাজিক—সব ধরনের সূচকেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ, সেই পাকিস্তানকে প্রায় সব ক্ষেত্রে পেছনে ফেলে এ দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকার এখন ৪১০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময়হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩৫ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ৫০ বছর আগে জিডিপির আকার কত ছিল, তার কোনো সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দুই যুগে বাংলাদেশের সম্পদ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। ১৯৭১ সালে বা তার পরের বছরগুলোতে বাংলাদেশের সম্পদ কত ছিল, তার কোনো হিসাব সরকার বা কোনো সংস্থার কাছে নেই।

গত ৩০ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক এক হিসাব দিয়ে বলেছে, দুই যুগে বাংলাদেশের সম্পদ সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ৩ হাজার ১০৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

সংস্থাটি বলেছে, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯০৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সাল শেষে তা হয়েছে ৩ হাজার ১০৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এরই মধ্যে আরও তিনটি বছর শেষ হতে চলেছে; এই তিন বছরে বাংলাদেশের সম্পদ কতটা বেড়েছে, তার কোনো তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি বিশ্বব্যাংক।

১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৪৬টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে ‘দ্য চেঞ্জিং ওয়েলথ অব নেশনস ২০২১’ শিরোনামে বিশ্বসম্পদের পরিবর্তন নিয়ে প্রথমবারের মতো এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দীন আহমেদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে ১৯৭২ সালে যে যাত্রার সূচনা করেছিলেন, সেই পথ ধরে বাংলাদেশের ৫০তম বাজেটের আকার ৭৬৮ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকায়। মাথাপিছু আয় উঠেছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে। এই আয় শুধু পাকিস্তান নয়, আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের চেয়েও বেশি।

গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। প্রবাসী আয়ে বিশ্বে সপ্তম এখন বাংলাদেশ। আমদানির উল্লম্ফনের পরও ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে বন্ধুপ্রতিম দেশ শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের শরণাপন্ন হওয়ায় দেশটিকে রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার ধার দিয়ে ঋণদাতা দেশের খাতায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ।

পৌনে দুই বছরের করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আমদানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রপ্তানি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০ শতাংশের মতো। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। বেড়েছে ৫৩ শতাংশ।

গত অর্থবছরে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে আয় হয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।

অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোও একই গতিতে এগিয়ে চলেছে। ‘বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল’—এটা বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রী, এমপি বা সাংবাদিক বা বিশেষজ্ঞের মন্তব্য নয়; বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ ও সংস্থার প্রধানরা এখন হরহামেশা উচ্চারণ করেন এই কথা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এখন মাঝে-মধ্যেই বাংলাদেশের প্রশংসা করে বড় বড় প্রতিবেদন ছাপা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিবিদরা এখন তাদের দেশের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলেন।

গত সপ্তাহে ঢাকায় সফরে এসে বিশ্বব্যাংক ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ শ্যাফার বলে গেলেন, ‘বাংলাদেশ একটি অনুপ্রেরণামূলক উন্নয়ন সাফল্যের গল্প।’

২০২২ সাল বাংলাদেশের জন্য হবে একটি বিশেষ বছর। এ বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প চালু হয়ে যাবে।

২০২২ সালে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে; চলবে ট্রেনও। একই সময় রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্টোরেল। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে ততদিনে। এই টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে।

ফলে ২০২৩ সালে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে।

তবে বাংলাদেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা এখনও রয়েই গেছে। ইতিবাচক খবরে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে সরকারকে বেশি নজর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

বদলে যাওয়া শুরু

বাংলাদেশের এই অগ্রগতি গত তিন দশক ধরে বহাল থাকলেও তা দৃষ্টিগ্রাহ্য গতি পেয়েছে গত এক যুগ ধরে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

এরপর আরও দুই দফায় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই সময়ে বাংলাদেশ অর্জন করেছে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।

২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ এখন আর স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ নয়; উন্নয়নশীল দেশ।

অর্থনৈতিক সূচকের পাশাপাশি সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে এই ১৩ বছরে। কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এখন আলোচিত। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের এই সাফল্যের কথা দেশি-বিদেশি মানুষকে শোনান।

পাকিস্তানের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক উপদেষ্টা আবিদ হাসান বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে দিয়েছেন চমকপ্রদ তথ্য। গত মে মাসে তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে দেশটিকে বাংলাদেশের কাছে হাত পাততে হতে পারে।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল’ -এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি এ মন্তব্য করেন। ‘এইড ফ্রম বাংলাদেশ’ নামের ওই নিবন্ধে আবিদ বলেন, ‘২০ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না যে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণ হবে। বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এটি ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটলে ২০৩০ সালের দিকেই হয়তো বাংলাদেশের কাছে আমাদের সাহায্য চাইতে হবে।’

বাংলাদেশের সফল অগ্রযাত্রাকে ভালো উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে আবিদ বলেন, গত দুই দশকে প্রধান অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। ২০ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে ৫০০ শতাংশ, যা পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি।

তিনি লিখেছেন, ২০০০ সালে পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৭০০ শতাংশ, যা পাকিস্তানের বৃদ্ধির চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। ২০২০ সালে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

এক যুগে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৬ শতাংশ

করোনাভাইরাস মহামারির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) ক্রমাগত বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি।

গত ১২ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর চার বছরে এই হার ৭ শতাংশের ওপরে।

তবে করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মহামারির কারণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। কোনো কোনো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ।

মাথাপিছু আয়

জিডিপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাথাপিছু আয়। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলার। ভারতের ১ হাজার ৯৪৭ ডলার ও পাকিস্তানের ১ হাজার ২৬০ ডলার। শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৬৮২ ডলার।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৭৫৯ ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এক যুগে মাথাপিছু আয় সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে।

মাথাপিছু আয়ে ভারতকে বাংলাদেশের ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম মোদি সরকারের তীব্র সমালোচনা করে, প্রশংসা করে বাংলাদেশের।

মূল্যস্ফীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি বেশ কিছুদিন ধরে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন (অক্টোবর) তা কমে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি মহামারির মধ্যে বিশ্বের বড় বড় দেশের মূল্যস্ফীতির পারদ চড়লেও বাংলাদেশে সহনীয় ছিল। তবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয় মানুষকে।

রেমিট্যান্স

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসা শুরু হয়। ওই অর্থবছরে মাত্র ১ কোটি ১৮ লাখ পাঠিয়েছিলেন অল্পসংখ্যক প্রবাসী। এর পর থেকে প্রতি বছরই বেড়েছে; অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছে এই সূচক।

মহামারির মধ্যে অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন তারা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি, কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই উল্লম্ফন আর নেই। এই অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৮৬১ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ শতাংশ কম।

রিজার্ভ: মাত্র ১২ কোটি ডলার দিয়ে শুরু

স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নের (রিজার্ভ) কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই। হয়তো ওই সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে তেমন কোনো আয় দেশে আসেনি। রেমিট্যান্সও আসা শুরু হয়নি, বিদেশি ঋণ সহায়তাও মেলেনি। তাই রিজার্ভে কোনো বিদেশি মুদ্রার মজুতও ছিল না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৮১-৮২ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে বিদেশি মুদ্রার মজুত জমতে শুরু করে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ ডলার।

পাঁচ বছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। পরের ১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে।

২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। তখন আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) বিল পুরোটা পরিশোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই একবারই আকুর বিল পুরোটা শোধ না করে অর্ধেক করা হয়েছিল।

এরপর অবশ্য কখনই রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসেনি। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।

২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বেড়েই চলেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।

২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

এরপর রিজার্ভ বেড়েই চলেছে। একের পর এক রেকর্ড হয়েছে। করোনাকালে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ২৪ আগস্ট রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

তবে আমদানি বাড়ায় এবং রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ খানিকটা কমে এসেছে। মঙ্গলবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার।

আমদানি

স্বাধীনতার পর মূলত খাদ্যশস্য আমদানি করা হতো। আমদানি খরচ মেটাতে রিজার্ভে প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা না থাকায় বেশ বিপাকে পড়তে হতো সরকারকে। তবে সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর খাদ্য সাহায্য হিসেবে আসত। তাই আমদানির সঠিক কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আশির দশকে পোশাক রপ্তানি বাড়তে থাকায় এ খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি বাড়তে থাকে।

এরপর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পণ্য আমদানি।

অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর মতো আমদানিও বেড়েছে সমানতালে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে মোট ব্যয় হয়েছিল ২২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ২৫ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।

অর্থবছরের বাকি আট মাসে এ হারে আমদানি হলে অর্থবছর শেষে মোট আমদানি ব্যয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। তবে এটাকে করোনা পরবর্তী অর্থনীতির জন্য ‘ভালো’ বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমদানি বাড়ার ভালো দিকও আছে। দেশে বিনিয়োগ বাড়বে; কর্মসংস্থান হবে। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে।’

রপ্তানি

স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পণ্য রপ্তানি শুরু করে বাংলাদেশ। ওই অর্থবছরে ৩৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই এসেছিল পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে।

১৯৮০ সাল পর্যন্ত ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাট মোট রপ্তানিতে ৫০ শতাংশ অবদান রেখে রপ্তানি আয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে তৈরি পোশাক শিল্প প্রথম স্থানে চলে আসে।

এরপর থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন অধ্যায়। প্রতি বছরই বাড়তে থাকে রপ্তানি। তার ৮০ শতাংশেরই বেশি অবদান রেখে চলেছে পোশাক শিল্প।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেই আয় আড়াই গুণের বেশি বেড়ে ৪০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল, কিন্তু করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ৩৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে উঠে।

সেই ইতিবাচক ধারা চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকাররা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানিকারকরা বলছেন, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এবার অর্থবছর শেষে মোট রপ্তানি আয় ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

কৃষি খাত

কৃষিতেও সরকারের সাফল্য ঈর্ষণীয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতির মধ্যেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টায় বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে।

মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখন ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে কৃষির বাণিজ্যিক রূপান্তর শুরু হয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন সত্যিই অবাক করার মতো। বিশেষ করে গত এক যুগে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। অনেক স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষ। মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে।

‘এ সবগুলোই শেষ হবে আগামী বছর, ২০২২ সালে। আমার বিবেচনায় ২০২২ সাল হবে টার্নিং পয়েন্ট। ২০২৩ সাল থেকে শুরু হবে নতুন বাংলাদেশের পথচলা। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব। আর ২০৪১ সালের মধ্যে ঠিকই উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বাংলাদেশ।’

তিনি বলেন, ‘তবে ৫০ বছরের এই অর্জনে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব প্রশাসনে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। আমাদের ব্যাংকিং খাত কিন্তু ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। ব্যাংকগুলো যে বিপুল অঙ্কের প্রণোদনার ঋণ দিচ্ছে, সেগুলো যদি ঠিকমতো আদায় না হয়, তাহলে আরও সংকটে পড়বে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে; ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ১৪-১৫তে নিয়ে যেতে হবে। যে করেই হোক বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে।’

রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘বাংলাদেশের বদলে যাওয়া আসলে ২০০৯ সাল থেকে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর বাংলাদেশের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি ও অদম্য সাহস। নানা বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রিয় দেশকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।’

তিনি বলেন, “আমরা এখন যে জায়গায় এসে পৌঁছেছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা মনে পড়ে যায়। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। আসলেই কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।”

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণকে বাংলাদেশের জন্য বড় অর্জন আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের উন্নয়নের সঙ্গে মিল রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সফল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।


সর্বশেষ - রাজনীতি