‘ডিজিটাল নেটিভস’ বলে বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত টার্ম আছে – যারা মূলত ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির সর্বব্যাপী প্রভাবের মধ্যে বড় হয়েছে, তাদের এমন নামেই ডাকা হয়। যারা ১৯৮০ সালের পরে জন্ম নিয়েছেন, মূলত তাদেরকেই ‘ডিজিটাল নেটিভস’ হিসেবে গণ্য করা হয়ে আসছে। আর এর আগে জন্ম হলেও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ – এমন ব্যক্তিদের ডাকা হয় ‘ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্টস’ নামে।
১৯৮০ সালে জন্ম নেওয়া শিশুটি ১৯৯৫ বা তারও একটু পরে তথ্য প্রযুক্তির দুনিয়াতে ঢুকে থাকতে পারে। তখনকার সময়ে সেটাই বাকি দুনিয়ার জন্য ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য নয়। ফলে বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল নেটিভস বা ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্টস’ এসব টার্মের কোনও ব্যবহারই ছিল না। আমি বরং আমাদের এখানকার জন্য এই টার্মটাকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নেটিভস’ বা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ইমিগ্র্যান্টস’ করতে চাই। কেন এমনটা বলছি, তার কারণ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সেবার বাঁক বদলের সময় ২০০৮ সাল। এক্ষেত্রে সময় গণনা শুরু হবে ২০০৮ সাল থেকে। মূলত সেবার ১২ ডিসেম্বর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ টার্মটি ব্যবহার করেন। সময়কে পরাজিত করা সেই রাজনৈতিক ঘোষণার পরপরই যেন সব কিছু ভোজবাজির মতো কাজ করতে শুরু করে। চারিদিকে কেমন যেন হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করে। ওই সময় থেকেই আমরা আমাদের চারপাশে বহু ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ নেটিভস’ দেখতে পাচ্ছি, যারা হাতের মুঠোয় গোটা দুনিয়াকে নিয়ে ঘুরছে।
সেই ঘোষণার পর সবচেয়ে দূরের অজোপাড়া গায়েও ছড়িয়ে পড়েছে ডিজিটাল সেবা। গত কয়েক বছরে তো আমি নিজেও অনেকগুলো ডিজিটাল বিজনেস নিয়ে কাজ শুরু করি। কাজ করতে করতে আমি নিজেও ‘ডিজিটাল বাংলাদশে ইমিগ্র্যান্টস’ হয়ে গেছি। আমার এই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে ইমিগ্র্যান্টস’ হয়ে ওঠার পেছনের বড় কাজটিও করে দিয়েছে ২০০৮ সালের ওই ঘোষণা।
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ডিজিটাল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নির্ধারণের ঘোষণাটা যখন আসে – তখন আমার মতো দিন বদলের শ্লোগানে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন বহু তরুণ। বলতে বাঁধা নেই যে, স্বপ্নবাজ তরুণেরা – ঘোষণাটাকে এক রকম লুফেই নেন। আমার ভালো লাগা যে, আমার তৈরি করা কোম্পানি ‘নগদ’-এর হাত দিয়ে কয়েক কোটি মানুষ ডিজিটাল সেবা প্ল্যাটফর্মে উঠে এসেছে। আমার তো মনে হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটাই ছিল স্বপ্ন – মানুষের জীবনকে সহজ ও গতিময় করা।
১৩ বছর আগের সেই ঘোষণার পর থেকেই দেশে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ইমিগ্র্যান্টস’দের হাত ধরে একের পর এক ডিজিটাল সেবা কোম্পানি গড়ে উঠতে শুরু করে। হাজার হাজার ডিজিটাল গ্রাজুয়েট বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য রফতানি বাড়তে লাগল। দৈনন্দিন জীবনের সবটাই হাতের মুঠোয় চলে এলো। তাতে সাধারণ মানুষের জীবনমানেরও উন্নতি হলো। সব মিলে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে যে, ২০০৮ বাংলাদেশের জনজীবনে মোটা দাগে লেখা একটা সময় হয়ে গেলো। কে জানে কখনও হয়তো অনাগত তরুণদের মধ্যেও একটা ভেদ রেখা তৈরি হবে, এই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণাকে নিয়ে। তখন হয়তো কার জন্ম ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণার আগে আর পরে কার জন্ম – এ নিয়েও কথা হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের গতিতে পার-ক্যাপিটা আয় বা মোট দেশজ আয় – সব গ্রাফই উর্ধ্বমুখী হলো। যার চূড়ান্ত স্বীকৃতি আসলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন থেকে। যেখান থেকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি মিলল। আমার কাছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ‘ কেবল সব কিছুকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তুলে আনাই নয়। বরং জ্ঞানভিত্তিক উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর সবচেয়ে বড় অংশ। সেখানেও আমরা বড় রকমের উন্নতি করেছি। জ্ঞানের এই উন্নতি অর্থনৈতিক উন্নতির দিকেও ধাবিত করছে।
অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা অনুসারে ইতিমধ্যে এশিয়ার টাইগার স্বীকৃতিও এসেছে আমাদের কাছে। সামনে আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া। আমার বিশ্বাস সে লক্ষ্যে আমরা ভালোই এগিয়ে যাচ্ছি।
আমার বাবা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন এবং আমার জন্য স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করেছেন। আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছি এবং আমার সন্তানের জন্য উন্নত বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করছি। বাবা যেমন আমার জন্য অনেকটা পথ তৈরি করে দিয়েছেন, আমিও আমার সন্তানের জন্য উন্নত বাংলাদেশের পথ মসৃণ করে যাবো। জয় আমাদের হবেই। উন্নত বাংলাদেশই হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।
লেখক: তানভীর আহমেদ মিশুক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডাক বিভাগের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’।