1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

যেভাবে বাতিল হলো কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২

১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বাতিল করা হয় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাক কর্তৃক ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। সেই অধ্যাদেশে খন্দকার মোশতাক ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের হত্যাকারী ঘাতকদের বিচার রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ করেন। দুই অংশের এই অধ্যাদেশের প্রথম অংশে লেখা হয়-

“১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।”

দ্বিতীয় অংশে বলা হয়-

“রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হল। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।”

এটি যেহেতু একটি অধ্যাদেশ ছিল তাই নির্দিষ্ট সময়ের পর উক্ত অধ্যাদেশের কার্যক্রম আপনাআপনি বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য খন্দকার মোশতাক- পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের সরকার ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার মাধ্যমে গঠিত সংসদে আনীত পঞ্চম সংশোধনীর সংযুক্তি হিসেবে ৯ জুলাই পাস করে। খন্দকার মোশতাক সরকার সামরিক বাহিনীর একটি অংশের সমর্থন নিয়ে রক্তাক্ত ১৫ আগস্টকে সংঘটিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে।

যারা বঙ্গবন্ধুসহ ওই রাতে খুনিদের হাতে নিহত হয়েছিলেন সেই খুনিদেরকে বিচার থেকে রক্ষা করার জন্যই খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি তথা দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে। ১৫ আগস্টের রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী এবং খন্দকার মোশতাক সরকারের আদর্শের অনুসারী পরবর্তী জিয়াউর রহমান সরকার ওই খুনিদের সুরক্ষা দিতেই অধ্যাদেশটি বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে আনীত পঞ্চম সংশোধনীতে অতিরিক্ত সংযুক্তি হিসেবে পাস করে নেয়। এর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের সরকার ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘোরতর সমর্থক হিসাবেও অবস্থান স্পষ্ট করে।

বাংলাদেশকে ২৬ সেপ্টেম্বর দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি এবং ৯ জুলাই (১৯৭৯) সেটিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানকে কলঙ্কিত করেছিলো। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিচারবহির্ভূত রাখার যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, সেটি সেই সংসদের চরিত্র নিয়েও যেমন প্রশ্ন তোলে, একইভাবে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সেই বিচারবহির্ভূতভাবে খুনিচক্রের সদস্যদের দেশের রাজনীতিতিতে কিংবা বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে চাকরি এবং আশ্রয় লাভের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজজীবনকেও নিন্দিত ঘাতক প্রভাবিত রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

খুনিচক্র জিয়াউর রহমানের সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছিলো, একইভাবে ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিএনপির নির্বাচিত সরকারও তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে এমনকি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনে লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসতে সুযোগ করে দেয়া হয়। এছাড়া কর্নেল ফারুকসহ অপরাপর ঘাতকদের নিয়ে ফ্রিডম পার্টিকে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়াতে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে বিএনপি। ১৫ আগস্টের ঘাতকচক্র প্রতিবছর ১৫ আগস্ট উদাযাপনকারীদের ওপর আক্রমণ ও হামলা করতে সরকারি সমর্থন লাভ করেছিলো। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি ও জামায়াতের গঠিত জোট সরকার পুনরায় ১৫ আগস্টের ঘাতকদের পক্ষাবলম্বন করে। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সমাপ্ত করতে বাধা দেয়।

উচ্চ আদালতে নিম্ন আদালতের রায় নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়। ঘাতকদের দেশের ভেতরে আসা যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এমনকি নিম্ন আদালতের রায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদেরও বিদেশি দূতাবাসে চাকরি করার সুযোগ করে দেয়। ফলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নিয়ে খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, অংশত এইচএম এরশাদ সরকার, বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার একই নীতি অনুসরণ করেছিলো। তারা খুনি ও ঘাতকদের বিচারের বিরুদ্ধে এবং সেটিকে রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেয়। সেই অবস্থানে রাজনীতিতে এখনও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে চলে এসেছিল সেটি পৃথিবীর সভ্য দেশে কল্পনা করা যায় না। কোনো হত্যাকাণ্ডকেই বিচারের বাইরে নেয়ার অধিকার রাষ্ট্রের নেই ঘাতকদের রক্ষা করার পক্ষাবলম্বনকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল এবং সরকার দেশে এর মাধ্যমে আইনের লঙ্ঘন বিচারের বিপক্ষে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি বলে স্বীকৃত হতে বাধ্য করে।

এমন একটি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত একটানা শাসিত হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে সরকার গঠনে শেখ হাসিনাকে জাসদ ও জাতীয় পার্টি সমর্থন করায় শেখ হাসিনা ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। গঠিত সংসদের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সরকার সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর দায়মুক্তি আইন অনুচ্ছেদটি বাতিলের উদ্যোগ নেয়।

১২ নভেম্বর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ‘দ্য ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ চূড়ান্তভাবে উত্থাপন করেন। এই আইনটি পাসের বিরোধিতা করে বিএনপি এবং জামায়াত ওইদিন হরতাল ডাকে এবং সংসদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। সপ্তম জাতীয় সংসদে বিএনপির ১১৬ এবং জামাতের ৩ সদস্য এই বিলটির বিরোধিতা করে অনুপস্থিত ছিলেন। জাতীয় পার্টির ৩২, জাসদের ১ ও স্বতন্ত্র সদস্য ১ জন এই বিলের পক্ষে সমর্থন জানায়। বিলটি পাসের জন্য ১৫০টি ভোটের প্রয়োজন ছিল। সেটি অনায়াসেই সরকার লাভ করায় বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা হরতাল কিংবা অনুপস্থিতি আইনটি পাস করতে কোনো সমস্যা হয়নি।

দায়মুক্তি আইনের বিরোধিতা করে হরতাল, সংসদে অনুপস্থিত থাকার নজির সৃষ্টি করে বিএনপি ও জামায়াত ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায়ভার গ্রহণ করে। সেদিন হরতাল চলাকালে ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা দায়মুক্তি আইন পাসের বিরুদ্ধে যেসব বিক্ষোভ করে তার ফলে নেতাকর্মীরাও এই মৌলিক অধিকারপরিপন্থি অধ্যাদেশের পক্ষশক্তি হিসেবে তারাও চিহ্নিত হয়ে যায়। সেটি খুব বেশি প্রমাণের অপেক্ষাও রাখে না।

১৯৭৫-এর পর থেকে বাংলাদেশ দুটি বিশেষ রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এটি আগে হয়তো ততটা স্পষ্ট বোঝা যেত না। তবে জামায়াত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় দলটি স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে স্বীকৃত ছিল। বিএনপি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। দলে তিনি উগ্রডান, উগ্রবাম ও সুবিধাবাদী দলছুট নেতাদের পদ-পদবি দিয়ে দলভুক্ত করেন।

তার গঠিত সরকারেও তিনি স্বাধীনতা বিরোধিতাকারীদের গুরত্বপূর্ণ পদে বসান। তিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, অন্যতম সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে বসানো হয়, ৭ নভেম্বর তিনি ক্ষমতা দখল করেন এবং পরবর্তীকালে তিনি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের একজন সুবিধাভোগী হিসেবে ক্ষমতা, রাজনীতি ও দল পরিচালনা করেন। তাতে ১৫ আগস্টের ঘাতকরা সরাসরি তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। একই সঙ্গে জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী সকল দলকে দেশের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকে কঠিন করে ফেলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সেকারণেই দেশের রাজনীতিতে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি বাস্তবেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ধারায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ করছে। সেকারণেই ১২ নভেম্বর তারিখে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিলের বিরোধিতা বিএনপি ও জামায়াত অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে।

এটি এখনও বহাল আছে। ২০-দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সব দলই ১৫ আগস্টের ঘাতকদের পক্ষাবলম্বন করে থাকে। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের রাজনীতিকেই তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে হলেও ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ করেছে। সেকারণে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলে বিএনপি জামায়াতসহ উগ্র ডান, উগ্রবাম প্রায় সবাই বিচারের বিরোধিতা শুরু করে। নিম্ন আদালতে রায় ঘোষণার দিন হরতাল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিচারকের রায়ের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানও প্রকাশ করে। এটি প্রকাশ্যেই তারা ঘটিয়েছিল।

এর মানে হচ্ছে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিরুদ্ধে তাদের নির্লজ্জ অবস্থান জানিয়ে দেয়া। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে গঠিত বিএনপি ও জামায়াত সরকার উচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া অকার্যকর করে রেখেছিল। এটিও আইন বিচার এবং মানবতাবাদীবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।

অপরদিকে ১২ নভেম্বর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী থেকে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করার পর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার করার বাধা দূর হয়ে যায়। সেই আইনবলেই বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৫ আগস্টের কয়েকজন ঘাতকের রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়, কয়েকজন খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে, কেউ কেউ মারাও গেছে। তারা এখন বিচারের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী। বাংলাদেশ সংবিধানকে কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে ১৫ আগস্টের ঘাতকদেরও বিচার করতে সক্ষম হয়েছে। একারণেই দিনটি ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে।

লেখক : মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী – গবেষক ও অধ্যাপক


সর্বশেষ - রাজনীতি