অমিতোষ পাল
রাজধানীর ৪৫/১/বি পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা স্মরণিকা তরফদার তার শিশুকন্যা শ্রীযাকে স্কুলে ভর্তি করাবেন। শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য সম্প্রতি মিরপুর ২ নম্বরসংলঘ্ন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে গেলে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা তার কাছে জানতে চান, ঢাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে কি-না। উত্তরে ‘না’ সূচক জবাব দিলে তাকে জানানো হয়, ঢাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট না থাকলে এখন থেকে আর সিটি করপোরেশন কোনো ব্যক্তি বা তাদের সন্তানকে জন্মনিবন্ধন সনদ দেবে না। স্থায়ী বাসস্থানের ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করতে হবে।
অগত্যা ফিরে যান স্মরণিকা। শুধু তিনি নন, তার মতো অনেকেই সন্তানের জন্মসনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রতিদিনই ফিরে যাচ্ছেন। কারণ, বসবাস করলেও ঢাকায় তাদের স্থায়ী বাসস্থান নেই। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের ভালো স্কুলগুলোতে শুরু হয়েছে ভর্তির তোড়জোড়। যে কোনো স্কুলে ভর্তি হতে গেলেই শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। এ ছাড়া অন্তত ১৬টি প্রয়োজনে মানুষের জন্মনিবন্ধন সনদের প্রয়োজন পড়ে। এত দিন খুব সহজেই সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ পাওয়া গেলেও এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না।
ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন অস্থায়ী ঠিকানায় অবস্থান করা দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষ। রাজধানীতে তা আরও ভয়াবহ। কারণ, রাজধানীতে যারা বসবাস করেন, তার সিংহভাগেরই ঢাকায় স্থায়ী বাসস্থান নেই। যেখানে জন্ম সেখানেই নিবন্ধন, এটা প্রচলিত নিয়ম। উন্নত বিশ্বেও এটা অনুসরণ করা হয়। শুধু জন্মগ্রহণের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পায় অনেক শিশু। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে জন্ম নিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না জন্মসনদ। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন প্রকল্পের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব জ্যোতির্ময় বর্মণ সমকালকে জানান, ভুয়া জন্মনিবন্ধন ঠেকাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে এমন ঘটনাও এসেছে, আপন দুই ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান মাত্র এক মাস। এ রকম অনেক সমস্যা ধরা পড়ছে। কাজেই জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে ঢাকায় বসবাসরত ব্যক্তির সন্তানদেরও সিটি করপোরেশন থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সন্তানের পিতামাতার স্থায়ী ঠিকানার বাড়ির দলিল, ভূমিকর, পৌরকর বা বিদ্যুৎ বিলের মতো প্রমাণপত্র দিতে হবে। সঙ্গে ঢাকায় জন্মগ্রহণের প্রমাণপত্রও উপস্থাপন করতে হবে। স্থায়ী বাসস্থান ব্যতিরেকে অন্য স্থান থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করা যাবে না। এ ব্যাপারে একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নীতিমালা ২-এর ২৪ উপধারায় এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, ব্যক্তির নিজের বা পিতামহের স্থাবর সম্পত্তিসহ বসবাসের ঠিকানা স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নদীভাঙন হলে নতুন স্থানে জমি কিনে কমপক্ষে তিন বছর বসবাস করেছেন এবং কর পরিশোধ করেছেন- আবেদনকারীর এমন জায়গাকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে গণ্য করা হবে।
নতুন এই নিয়মের ফলে রাজধানীর বাসিন্দাদের সন্তানের জন্য তাকে গ্রামে গিয়ে জন্মসনদ সংগ্রহ করতে তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এই কঠোর নীতিমালা আরোপ প্রসঙ্গে নিজেও এই ভোগান্তির শিকার উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ সমকালকে বলেন, নতুন নিয়মে অনেক সমস্যা হচ্ছে। মানুষের অনেক ভোগান্তি হচ্ছে। কিন্তু যে দেশে এখনও ৪০ শতাংশ শিশুর জন্ম পরিবারে হয়, সেখানে জন্মতারিখ নিশ্চিত করাও কঠিন। আবার কেউ সিটি করপোরেশনে গেলেই যে তাকে জন্মসনদ দিয়ে দেওয়া হবে, এটাও তো ঠিক নয়। কারণ, এরই মধ্যে অনেক ব্যক্তির অথেনটিকেশন (সত্যতা) নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাজেই প্রমাণপত্র ছাড়া কোনো সার্টিফিকেট দেওয়া ঠিক নয়। তাহলে সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। এই সনদের ওপর ভিত্তি করেই তার জীবনের ভবিষ্যতের অনেক কিছু হবে। সেই সনদ যেনতেনভাবে হতে পারে না। তবে সেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে ভোগান্তি নিরসনের সহজ পথটা খুঁজে বের করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সমকালকে বলেন, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদেশে চলে যাওয়া, জঙ্গিবাদের মতো নানা কারণেই এ নীতিমালা কঠিন করা হয়েছে। এতে জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে। এটা কোনোভাবেই এত কঠিন করা ঠিক না। এ ক্ষেত্রে কেউ ঢাকায় বসবাসের উপযুক্ত প্রমাণপত্র দেখাতে পারলেই তার জন্মসনদ ইস্যু করা উচিত। যেমন- চাকরিজীবীর চাকরির প্রমাণপত্র, ব্যবসায়ী ব্যবসার প্রমাণপত্রের মতো উপযুক্ত প্রমাণপত্র দেখাতে পারলেই তাকে বা তাদের সন্তানকে জন্মসনদ দেওয়ার বিধান করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নীতিমালাটি এমন হতে হবে, যাতে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করা যায়।
জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সে সময় জন্মসনদ ইস্যু নিয়ে সিটি করপোরেশন কড়াকড়ি আরোপ না করলেও ১ অক্টোবর থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ১ জুলাই থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ শুরু করে। রাজধানীর স্কুলগুলোতে ভর্তিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি অভিভাবকরা শিশুর জন্মসনদ গ্রহণ করতে গেলে সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শেখ মো. সালাহউদ্দিন সমকালকে বলেন, ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা না হলে কেউ সিটি করপোরেশন থেকে কোনো জন্মসনদ গ্রহণ করতে পারবে না। এ নিয়ম কেবল সাধারণ মানুষের জন্যই নয়, এমনকি ঢাকায় যারা সরকারি চাকরি করেন, তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ ব্যাপারে দুই সিটি করপোরেশনে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।
জানা গেছে, শিশুদের স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে পাসপোর্ট ইস্যু, ব্যাংক হিসাব খোলা, যে কোনো ধরনের লাইসেন্স ইস্যু, সেবা সংযোগপ্রাপ্তি, বাড়ির নকশা অনুমোদনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে জন্মসনদের প্রয়োজন হয়। এত দিন পিতামাতার পরিচয়পত্র, শিশুর টিকাদান বা শিশুর জন্মের হাসপাতালের যে কোনো কাগজপত্র দেখালে বিনা অর্থেই যে কেউ জন্মসনদ নিতে পারতেন। নতুন আইনে ব্যাপক হারে ফি বাড়ানো হয়েছে। বয়সভেদে একজনের জন্মসনদ নিতে গেলে এক হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ভুল সংশোধনের বিষয়টি ছিল সহজসাধ্য। এখন ভুল সংশোধন করতে গেলেও অনেক ঝক্কি পোহাতে হবে। রেজিস্ট্রার জেনারেলের অনুমোদন ছাড়া কোনো সনদ সংশোধন করা যাবে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এমদাদুল হক সমকালকে বলেন, জন্মসনদের ব্যাপারে আগে অনেক কিছুই সহজ ছিল। এমনকি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকেও অনেক সময় সনদ ইস্যু করা হতো। এখন সে ব্যাপারেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে যেন কোনো সার্টিফিকেট ইস্যু করা না হয়।
নতুন বিধিমালায় আরও যেসব ভোগান্তি :জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে উপযুক্ত দলিল ও প্রমাণাদি দিয়ে জন্মনিবন্ধনের সুযোগ বিদ্যমান আইনে থাকলেও এ সময়ের মধ্যে কেউ ব্যর্থ হলে বিলম্বের কারণ উল্লেখ করে ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে আবেদনকারীকে হলফনামা দিতে হবে। আগে একদিনের মধ্যে সনদ ইস্যু করা হলেও এখন সেটা করা হবে না। কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য নিবন্ধক বা কর্তৃপক্ষ ১৫ কর্মদিবস সময় নিতে পারবেন। পরে সাত কর্মদিবসের মধ্যে সনদ ইস্যু করা হবে। পরবর্তী সাত কর্মদিবসের মধ্যে সেটা অনলাইনে তালিকাভুক্ত হবে।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালার ১০ ধারার ১১ উপধারায় বলা হয়েছে, ইস্যু করা জন্মসনদে কোনো ভুল সংশোধন করতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করতে হবে। তিনি তদন্ত করে ভুলের পক্ষে সত্যতা পেলে সরাসরি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠাবেন। রেজিস্ট্রার জেনারেলের অনুমোদন ছাড়া কোনো ভুল সংশোধন করা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রেও উপযুক্ত প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে হবে।