1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কর্মের মাধ্যমেই বাঁচার আশা তৈরি করতে হবে

ড. মতিউর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আত্মহত্যা একটি পুরোনো সমস্যা। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যাকে একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (আইএএসপি) এবং বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য ফেডারেশন একযোগে ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে আসছে। দিবসটি বিভিন্ন দেশের সরকার, বিভিন্ন সংস্থা এবং জনগণের মধ্যে আত্মহত্যা প্রতিরোধের প্রতি মনোযোগ বাড়ায়, আত্মহত্যাজনিত কলঙ্ক কমায় এবং আত্মহত্যা যে প্রতিরোধ করা যেতে পারে এমন বার্তা দেয়।

“কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করো” (Creating hope through action) হল ২০২১-২০২৩ পর্যন্ত বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের ত্রিবার্ষিক থিম। এই থিমটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আত্মহত্যার একটি বিকল্প রয়েছে এবং আমাদের সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার এবং আলোর ধারায় অনুপ্রাণিত করার মতো বিষয় রয়েছে।

ডব্লিউএইচও বলছে আত্মহত্যাজনিত প্রতিটি মৃত্যুই একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য উদ্বেগ যা আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির পরিবার ও তার আশেপাশের লোকদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এমতাবস্থায়, জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে, আত্মহত্যাকেন্দ্রিক কলঙ্ক কমিয়ে, এবং সুচিন্তিত পদক্ষেপকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে, আমরা বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যার ঘটনা কমাতে পারি।

আইএএসপি এর এক তথ্যগ্রাফী দেখায় যে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৭০৩,০০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার হার নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি। অর্ধেকেরও বেশি (৫৮%) মানুষ ৫০ বছর বয়সের আগে আত্মহত্যা করে থাকে। বিশ্বের সব অঞ্চলেই আত্মহত্যা সংঘঠিত হয়, তবে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার তিন চতুর্থাংশ (৭৭%), নিন্ম এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঘটেছে।

অপরদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় প্রায় ৮ লাখ মানুষ। দিন প্রতি এ হার ২,১৯১ জন। প্রতি লাখে প্রায় ১৬ জন। বিগত ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতি বছরই এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। কাজেই আত্মহত্যা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

গত কয়েক বছরের তথ্য থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশে আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ২০১৬ সালে, দেশে ৯,০০০ এরও কম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সংখ্যাটি যথাক্রমে ১০,০০০ এবং ১১,০০০ এর বেশি ছিল। করোনা মহামারিকালে অর্থাৎ ২০২০ সালে সারা দেশে ১৪,০০০ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। সুতরাং আত্মহত্যার ঘটনা যে বাড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আত্মহত্যার প্রবণতার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে রয়েছে নারী, পুরুষ, শিশু এবং সব বয়সের মানুষ। বয়স বিবেচনায় ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীদের আত্মহত্যার হার বেশি। এই পরিসংখ্যানের বাইরে, আরো অনেক আত্মহত্যার ঘটনা রয়েছে যা আমাদের অজানা রয়ে গেছে। গত এক দশকে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে দেশে আত্মহত্যার হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

এ বছর (২০২২) জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বেসরকারি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যাতে দেখানো হয়েছে, গত বছর (২০২১) করোনা মহামারিকালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১০১টি। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে যা ৬১.৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন। এছাড়াও অতি সম্প্রতি দুই নারী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা দেশব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এভাবে প্রতিদিনই দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।

সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রবণতার কারণগুলো বিভিন্নভাবে উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিষন্নতা এবং মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন, অন্যদিকে, সমাজবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন যে সামাজিক কারণগুলো হতাশা এবং মানসিক অসুস্থতার জন্য দায়ী। সুতরাং, সামাজিক কারণগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা সংঘটনের জন্য দায়ী।

সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘সুইসাইড’ নামক গ্রন্থে আত্মহত্যার জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে সামাজিক কারণগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর মতে আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি মূলত সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সাথে আত্মহত্যাকে সম্পর্কিত করে দেখার চেষ্টা করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে ডুর্খেইম বলেন, যারা সমাজের সাথে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত তারা আত্মহত্যা করে। আবার যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন তারাও আত্মহত্যা করে। এই গ্রন্থে তিনি নিন্মে বর্ণিত মোট চার ধরনের আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেমন, আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যা; পরার্থপর আত্মহত্যা; নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা; এবং নিয়তবাদী আত্মহত্যা। তবে অনেক সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইম এর মতবাদকে সমালোচনাপূর্বক প্রত্যাখান করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মহত্যার চিন্তা জটিল এবং যেসব কারণ আত্মহত্যার দিকে পরিচালিত করে তা আরো জটিল ও বহুমাত্রিক। কোন একক কারণ সবার জন্য সমানভাবে কাজ করে না। আমরা যা জানি তা হলো যে কিছু নির্দিষ্ট কারণ এবং জীবনের ঘটনা আছে যা কাউকে আত্মহত্যার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা যেমন উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতাও এক্ষেত্রে অবদান রাখে।

যারা আত্মহত্যা করে তারা তাদের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং তাদের আশেপাশের লোকদের সাথে প্রবল সংহতিবোধ করতে পারে। আবার তারা নিজেদেরকে অন্যদের কাছে বোঝাও মনে করতে পারে। সুতরাং উভয় ক্ষেত্রেই কারোর জন্য আত্মহত্যার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এবং এইভাবে তারা মনে করে যে আত্মহত্যা ছাড়া তাদের কোন বিকল্প নেই। কভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষের জন্য বিচ্ছিন্নতা এবং দূর্বলতার অনুভূতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে যা অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাকে তীব্র করে তুলেছে।

আত্মহত্যা মহাপাপ। আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। পৃথিবীর সকল ধর্মে এবং নৈতিকতায় আত্মহত্যার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। তাহলে মানুষ কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? আত্মহত্যা নির্মূল বা কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টা রয়েছে। আইন, বিধি ও নীতিমালাও রয়েছে। কিন্তু তাসত্ত্বেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। যদি আমরা আত্মহত্যার পেছনের গল্পটি দেখি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই যে চিত্রটি মনে আসে তা হল যৌতুক, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাঙ্খার মধ্যে পার্থক্য, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনতা, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, ইত্যাদি।

এসব কারণে অনেকেই আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ বেছে নেয়। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর থেকে পরিত্রাণের জন্য, সাইকোথেরাপি, ইতিবাচক মনোভাব, সহানুভূতি, বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করা, কথা বলার ও আবেগ ভাগাভাগি করার পরিবেশ তৈরি করা এবং আত্মসমালোচনা অপরিহার্য। আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে হলে নীতিনির্ধারকদের প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আরো বেশি করে সমন্বিত প্রকল্প ও কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য যোগ্যতা অনুয়ায়ী কর্মের সুযোগ সৃষ্টি ও কর্ম নিশ্চয়তা প্রদান। ক্রমবর্ধমান অসমতা দূরীকরণ ও সেইসাথে দরকার সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশেষত কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এই বিষয়ের পরিসংখ্যান এবং তার ফলাফল যথেষ্ট ভীতিকর। কভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে আমরা যতখানি আতঙ্কিত, আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করা অসংখ্য মানুষকে নিয়ে কিন্তু আমরা ততোটা চিন্তিত নই।

এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা যদি তাদেরকে শেখাতে পারি যে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না কেনো, সেটা জীবনেরই অংশ এবং আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে তাদেরকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। ফলশ্রুতিতে এই শিক্ষার্থীরা যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তবমুখী কিছু জ্ঞান যেমন- আর্থিক ব্যবস্থাপনা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি আত্মহত্যা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আইএএসপি যেমন বলেছে আত্মহত্যা রোধ করা প্রায়শই সম্ভব এবং এর প্রতিরোধে আমি, আপনি সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। কারো জীবনের কঠিনতম সময়ে আমাদের কর্মের মাধ্যমে―সমাজের সদস্য হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, বাবা-মা হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে বা প্রতিবেশী হিসেবে অবদান রাখতে পারি। যারা আত্মঘাতী হবার মতো সংকটে ভুগছেন বা যারা কারো আত্মহত্যায় শোকাহত তাদের সহায়তায় আমরা সবাই ভূমিকা রাখতে পারি। তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি- সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ জীবনের জন্য যা অপরিহার্য। অন্যথায় এ মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব হবেনা বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

লেখক : ড. মতিউর রহমান – গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।


সর্বশেষ - রাজনীতি