1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

নওগাঁর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শত শত টন ধান-চাল মজুতের অভিযোগ

নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০২৩

নওগাঁর চালকল মালিকদের অনেকের বিরুদ্ধ নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত শত শত টন ধান-চাল মজুদ করার অভিযোগ উঠেছে। খোদ নওগাঁর ব্যবসায়ীরাই বলছেন, জেলার প্রভাবশালী মিলারদের অনেকেই এখন তাদের গুদামে চাল মজুদ করছেন। আর তা করতে গিয়ে সরকারের মজুদ নীতিমালারও লঙ্ঘণ করছেন তারা।

বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্য চালের অন্যতম বৃহত্তম সরবরাহকেন্দ্র উত্তরের জেলা নওগাঁ। স্থানীয় উৎপাদনের পাশাপাশি আশপাশের অন্যান্য জেলা থেকেও প্রচুর পরিমাণে চালের সরবরাহ আসে এখানে। এর বাইরে প্রতিবেশী ভারত থেকেও বৈধ-অবৈধ পথে অনেক চাল প্রবেশ করে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে চালের সবচেয়ে বড় সরবরাহ যায় এ জেলা থেকেই। এ কারণে জাতীয়ভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণেও এখানকার ব্যবসায়ীদের প্রভাব অনেক বেশি।

সর্বশেষ বোরো মৌসুমে নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চাল উৎপাদন হয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। উৎপাদনের প্রধান মৌসুমে ধানের ভালো ফলনের কারণে বাজারে প্রকৃতপক্ষে চালের সরবরাহ সংকট দেখা দেয়ার মতো পরিস্থিতি নেই বলে জানিয়েছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, নওগাঁয় এ বছর বোরো, আউশ ও আমন মৌসুমে ১৬ লাখ টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় চাহিদা রয়েছে মাত্র ছয় লাখ টন। বাকি ১০ লাখ টন উদ্বৃত্ত। পাশাপাশি উত্তরের প্রতিবেশী অন্যান্য জেলা ও ভারত থেকেও প্রচুর চাল প্রবেশ করেছে নওগাঁর বাজারে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজের জেলায় উৎপাদিত চালের পাশাপাশি দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ধান সংগ্রহ করে নওগাঁর চালকলগুলো। শুধু সরকারি গুদামে দেয়ার জন্যই বছরে তারা প্রায় দুই লাখ টন মোটা ধান বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করে। এরপর সেগুলো থেকে চাল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ (ব্রি) দেশী-বিদেশী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক যৌথ গবেষণায়ও এ তথ্য উঠে এসেছে।

বোরো মৌসুমে ফলন ভালো হলে বিগত বছরগুলোয় নওগাঁর চালের বাজারে দাম কমতে দেখা গেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে এবার। ভালো ফলন সত্ত্বেও টানা এক মাস ধরে জেলার খুচরা ও পাইকারি বাজার এবং মিলগেটে চালের দাম অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এর জন্য বড় মিলারদের সক্রিয় একটি সিন্ডিকেটকে দায়ী করে অভিযোগ তুলছেন স্থানীয় খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা।

শহরের পৌর চাল বাজার এলাকার খুচরা চাল ব্যবসায়ী মানিক প্রামাণিক বলেন, বড় মিলাররা গুদামে হাজার হাজার টন পুরনো চাল ও ধান মজুদ করে রেখেছেন। তাদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। মিলগেট থেকে বেশি দামে সরবরাহের কারণে ভোক্তা পর্যায়েও চালের দাম পড়ছে বেশি। এসব মিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই চিকন চালের দাম ৫০ টাকা কেজিতে নেমে আসবে।

কয়েকটি গুদামে গিয়ে অতিরিক্ত চালের মজুদ দেখেছে ঢাকা। খাদ্য বিভাগের ফুড গ্রেইন লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী, একজন মিলার অনুমোদিত সক্ষমতার সর্বোচ্চ দ্বিগুণ পরিমাণ চাল দুই মাস পর্যন্ত মজুদ রাখতে পারবেন। ধানের ক্ষেত্রে মজুদ করতে পারবেন অনুমোদিত সক্ষমতার তিন গুণ। সেটিও সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত। যদিও এ নিয়মের লঙ্ঘন করেই দীর্ঘদিনের পুরনো হাজার হাজার টন চাল ও ধান মিলের গোডাউনে সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন জেলার প্রভাবশালী চালকল মালিকরা। এমনকি সরজমিনে কোথাও কোথাও গত বছর উৎপাদিত ধান-চালও এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে দেখা গেছে। মিলের গোডাউনের বাইরে অন্য স্থানেও ধান-চাল মজুদের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

চালকল মালিক গ্রুপের হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে নওগাঁয় সচল চালকলের সংখ্যা ৫৭১। এর মধ্যে ৫৩টি অটোমেটিক ও ৫১৮টি হাসকিং মিল। এসব মিলে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার টন চাল উৎপাদন সম্ভব। জেলার ১১টি উপজেলায় স্থানীয় ভোক্তাপর্যায়ে চাহিদা রয়েছে ৮০০ টন চালের। এ চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত চাল দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করার কথা।

নওগাঁ শহরের সুলতানপুর মহল্লার ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলে সরজমিন গিয়ে হাজার হাজার টন চালের মজুদ রাখতে দেখা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে মজুদকৃত চালের বস্তাগুলো মাকড়সার জাল ও ধুলায় ছেয়ে গেছে। ঢেকে গেছে অধিকাংশ বস্তার গায়ে লেখা চালের নাম ও বিবরণ। এছাড়া মজুদকৃত চালের ৯০ শতাংশই সংরক্ষণ করা হচ্ছে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের বস্তায়। ধানের গুদামে গিয়ে গত বছরের মজুদকৃত ধানের বস্তাও দেখা গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে গুদামে সংরক্ষণ করায় অনেক বস্তার ধানে গজিয়েছে চারা। এসব দৃশ্যের ছবি ও ফুটেজ ঢাকা পোস্টে কাছে রয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মিলটির মালিক দ্বিজেন ঘোষ নিজেকে পরিচয় দেন সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর আত্মীয় হিসেবে। জানতে চাইলে ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী দ্বিজেন ঘোষ বলেন, মিলে পুরনো কোনো ধান-চাল মজুদ নেই। আমার বিরুদ্ধে অবৈধ মজুদের যে অভিযোগটি করা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়। গত তিন বছরে আমার মিলের মজুদ সংক্রান্ত কারণে কোনো জরিমানা করা হয়নি। তাছাড়া পাটের বস্তার দাম বেশি হওয়ায় প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করা হয়। মোকামে কেনাবেচা না থাকায় ব্যবসায় এখন মন্দা চলছে বলেও জানান এ ব্যবসায়ী। একই সঙ্গে মিল থেকে নেয়া ছবি ও ফুটেজগুলো ডিলিট করার জন্য এ প্রতিবেদককে তিনি অনুরোধ করেন।

দ্বিজেন ঘোষের মিল থেকে ২০০ ফুট দূরত্বেই সাপাহার চালকল। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ধান, চাল, চিনি, সয়াবিন তেলসহ নানা দ্রব্যাদির মজুদ। চালকলের মালিক মন্মথ সাহা বর্তমানে অসুস্থতাজনিত কারণে ভারতে আছেন। তার ছেলে মিঠুন সাহার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, মিলের মজুদ সক্ষমতা কত, তা জানা নেই। এবার মিল ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে। যাদের ভাড়া দিয়েছি তারাও মিল পরিচালনা করছেন না। চাল ব্যবসার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ডিলারশিপ নেয়া আছে। এজন্য গোডাউনে চালের পাশাপাশি কিছু দ্রব্যাদি রাখা হয়েছে। মজুদসংক্রান্ত নিয়ম-কানুন অতটা আমার জানা নেই।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে স্থানীয় এক চালকল মালিক বলেন, জেলায় যত অবৈধ মজুদদার রয়েছেন তাদের অধিকাংশই বেশ প্রভাবশালী। নিজেদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দেন। প্রশাসন বার বার মজুদবিরোধী অভিযান পরিচালনায় গিয়েও এ সিন্ডিকেটের কাছে দুর্বল হয়ে ফিরে আসে। সারা দেশে চালের বাজারে বর্তমান অস্থিতিশীলতার জন্য এ মজুদদাররাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রচুর পরিমাণে ধান-চাল মজুদ রাখায় নওগাঁসহ সারা দেশে চালের বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে।

একই বক্তব্য স্থানীয় আড়তদারদেরও। সততা রাইস এজেন্সির আড়তদার সুকুমার ব্রহ্ম বলেন, ভরা মৌসুমে ভালো কেনাবেচা হলে প্রতিদিন নওগাঁ মোকাম থেকে কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ টন চাল দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। এখানকার ব্যবসায়ীরা টানা এক মাস চাল সরবরাহ বন্ধ রাখলে সারা দেশে অস্থিরতা শুরু হয়ে যাবে। হু হু করে বেড়ে যাবে চালের দাম। দেশের বাজারে চালের দাম ওঠানামার ক্ষেত্রে এখানকার ব্যবসায়ীদের ভূমিকা অনেকটাই থাকে। অবৈধ মজুদের দিকে না এগোলে এমনিতেই বাজারে স্বস্তি বিরাজ করে।

জেলার প্রখ্যাত চালকল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলামও নিজেকে পরিচয় দেন ক্ষমতাসীন দলের হেভিওয়েট নেতাদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে। নিয়মবহির্ভূতভাবে ধান-চাল মজুদ রাখার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধেও। শহরের সুলতানপুর মহল্লায় ‘সুফিয়া এগ্রো এ্যারোমেটিক অটোমেটিক রাইস মিল’ নামে বড় একটি চালকলের মালিক তিনি। সম্প্রতি ওই কলে গিয়ে মজুদকৃত চালের ছবি ওঠাতে চাইলে প্রতিবেদককে বাধা দেওয়া হয়।

মজুদ নিয়ে জানতে চাইলে সরকারের একজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে সখ্য ও স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে আত্মীয়তার কথা সামনে নিয়ে আসেন ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রশাসনের পরিদর্শন বা এ ধরনের কার্যক্রম মোকাবেলার জন্য আমাদের চালকল ব্যবসায়ীদের সংগঠন আছে। সাংবাদিকদের যারা মিলের মজুদ দেখাবে, তারা পাগল। আমার মিলে কখনো কোনো সাংবাদিককে ঢুকতে দেয়া হবে না।

জাতীয় সংসদে গত ৫ জুলাই খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন-২০২২ পাস হয়েছে। এতে অবৈধ মজুদদারদের জন্য যাবজ্জীবন সাজার বিধানও রাখা রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের বিভিন্ন মাত্রার অনুমোদনবহির্ভূত কার্যক্রমের জন্য রাখা হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদি সাজা। এ নিয়ে আপত্তি তুলছেন নওগাঁর স্থানীয় চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও।

নওগাঁ জেলা অটোমেটিক রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, সংসদে পাস হওয়া আইনে শাস্তির বিধানে সরকারের নমনীয়তা প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে অংশীজন হিসেবে আমরা খসড়ায় মতামত দিয়েছিলাম। তবে অবৈধ মজুদকারীরা দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে প্রশাসনকে বরাবরই আমরা সাংগঠনিকভাবে সহযোগিতা করে আসছি। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কোনো সিন্ডিকেটকে পৃষ্ঠপোষকতা করে না বলেও দাবি করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।

এবিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ তানভীর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ধান-চাল মজুদ রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ। নিয়মানুযায়ী কোনো বন্ধ মিল সরকারের সংগ্রহ অভিযানে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে না। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে। কোথাও অবৈধ মজুদ পেলে ওইসব মিল মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই।

একই কথা বলছেন নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসানও। তিনি বলেন, মজুদবিরোধী অভিযানে কে কার আত্মীয় সেটা দেখা হয় না। অবৈধ মজুদ পেলে তাৎক্ষণিক সে মিল মালিক অথবা চাল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। খাদ্য বিভাগের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের মজুদবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে। নিয়মের বাইরে কেউ অবৈধ মজুদ কারলে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।


সর্বশেষ - রাজনীতি