টানাপোড়েনের সংসার। স্বামীই একমাত্র উপার্জনকারী। সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়া কোনোটিই ঠিকমতো চলছিল না। ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে করলেও তা হয়ে ওঠেনি কখনও। অভাব যখন সংসারে জেঁকে বসল, ঠিক তখন ‘কিছু করতে হবে’ বিষয়টি মাথায় এলো তানিয়ার। সে সময় ইউটিউব দেখে কেঁচো সার উৎপাদন পদ্ধতি রপ্ত করলেন তিনি। আর এতেই ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে তার। এখন তানিয়ার সব আর্থিক অভাব মুছে গেছে, তিনি আজ পুরোপুরি একজন স্বাবলম্বী নারী।
ফরিদপুরের নারী উদ্যোক্তা তানিয়া পারভীন ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদন করে মাসে লাখ টাকা আয় করেন। তার দেখাদেখি এখন আরও অনেক নারী এগিয়ে এসেছেন কেঁচো সার উৎপাদনে। জৈব এ সার মাটিকে তাজা করে। এর কোনো ক্ষতিকর দিক নেই আর দামেও বেশ সস্তা। তাই কৃষকেরও পছন্দ এই সার।
বাড়িতে বসেই কেঁচো ব্যবহার করে জৈবসার তৈরি করছেন নারী উদ্যোক্তা তানিয়া পারভীন। নিজেদের জমির চাহিদা মিটিয়ে এখন এ সার বিক্রি করছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। দিন দিন বাড়ছে এ সারের চাহিদা।
ফরিদপুর পৌরসভার শোভারামপুর এলাকার বাসিন্দা তানিয়া পারভীন। স্বামী ইদ্রিস সিকদার। দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল তার। হঠাৎ একদিন ইউটিউবে জৈব সার তৈরির প্রক্রিয়া দেখে আগ্রহ হয় তার। এরপর তানিয়া স্থানীয় কৃষি বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন জৈব সার তৈরি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় ২০১৭ সালে তিনটি রিংস্লাব দিয়ে কেঁচো সারের উৎপাদন শুরু করেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে বাড়িয়েছেন উৎপাদনের পরিধি। বাড়ির উঠানে তিনটি বিশাল টিনের শেড উঠিয়ে বসিয়েছেন ৩৬টি হাউস বা চৌবাচ্চা। প্রতিটি হাউস ৪ ফুট বাই ১০ ফুট আকারের।
সার উৎপাদনের জন্য প্রতিটি হাউসে ৪০ মণ গোবর, শাকসবজির উচ্ছিষ্টাংশ ও কলাগাছের টুকরার মিশ্রণ রেখে তাতে ১০ কেজি কেঁচো ছেড়ে দেয়া হয়। তারপর হাউস ঢেকে দেয়া হয় চটের বস্তা দিয়ে। এভাবে এক মাস ঢেকে রাখার পর তৈরি হয় ভার্মি কম্পোস্ট সার।
এভাবে প্রতি মাসে তানিয়ার ৩৬টি হাউস থেকে সব মিলিয়ে ১২ থেকে ১৫ টন সার উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতি কেজি সারের বিক্রয়মূল্য খুচরা ১৫ টাকা ও পাইকারি ১২ টাকা। খরচ বাদে প্রতি মাসে তানিয়ার আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, ‘এলাকার চাষিরা আমার কাছ থেকে সার নিয়ে চাষাবাদ করছেন। খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আমার এ জৈব সার। দেশের বিভিন্ন স্থানেও যাচ্ছে সার। আমার স্বামী আমাকে সহযোগিতা করছে। প্রায় এক লাখ টাকা মাসে আয় হচ্ছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে অনেক ভালো আছি। এখন অনেক নারী আমার কাছ থেকে জৈব সার তৈরি করা শিখতে আসছে।’
আনোয়ার হোসেন বলেন, তানিয়ার তৈরি জৈব সার এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলাতেও পাঠানো হচ্ছে। চাষিরাও এই সার ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ এ কে এম হাসিবুল হাসান বলেন, ‘জৈব পদার্থ হলো মাটির প্রাণ। ক্রমেই মাটির প্রাণ হ্রাস পাচ্ছে। তাই আমরা জৈব সার প্রয়োগের ওপরে জোর দিচ্ছি। কেঁচো সারে ফলন ভালো হয় এটা প্রমাণিত। আমরা চাষিদের সবজি ক্ষেতে ও ফলের বাগানে ভার্মিকম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে বলি। এ সারের যত ব্যবহার বাড়বে ততই ক্ষতিকর রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, নারী উদ্যোক্তা তানিয়া পারভীন কেঁচো দিয়ে জৈব সার উৎপাদন করছেন। জেলার বিভিন্ন কৃষক তার কাছ থেকে এ সার নিয়ে ফসল উৎপাদন করছেন। এ সার প্রয়োগে ফসল অনেক ভালো হচ্ছে। তানিয়ার তৈরি সার অনেক সুনাম কুড়িয়েছে।