খরগোশ ও ইঁদুরের ওপর কার্যকর ও সম্পূর্ণ নিরাপদ প্রমাণিত হওয়ার পর এবার বানরের ওপর পরীক্ষামূলকভাবে বঙ্গভ্যাক্সের প্রয়োগ করেছে দেশীয় কোম্পানি গ্লোব বায়োটেক। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, তাদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ বানরের ওপর মাত্র ১ ডোজ প্রয়োগ করেই ৯৫ শতাংশ কার্যকর অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে।
আগামী অক্টোবরে মানবদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) কাছে আবেদন করা হবে। গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি) ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন সময়ের আলোকে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, খরগোশ ও ইঁদুরের ওপর টিকা প্রয়োগ করে এটি কার্যকর ও সম্পূর্ণ নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। ৫৬টি বানর সংগ্রহ করে এ মাসের ১ তারিখ থেকে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করেছি, যা আগামী মাসে শেষ হবে। তারপরই মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য বিএমআরসির কাছে আবেদন করা হবে।
ড. মহিউদ্দিন বলেন, সারাবিশ্বে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ ১১টি ভেরিয়েন্ট বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় সক্রিয় ছিল। আমরা এই ১১টি ভেরিয়েন্টের সিকোয়েন্স অ্যানালাইজ করে আমাদের ভ্যাকসিনের সিকোয়েন্স মিলিয়ে দেখেছি। প্রতিটি ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রেই বঙ্গভ্যাক্স কার্যকর হবে। আমরা খুব আত্মবিশ্বাসী। এ টিকা যদি বাজারে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে সারা বিশ্বে করোনার যে মহামারি চলছে, বঙ্গভ্যাক্স তা থেকে পরিত্রাণ দেবে।
তিনি আরও বলেন, বানরের ওপর টিকার পরীক্ষার জন্য বিদেশে চেষ্টা করেছি। ভারত বলছে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে আবেদন করতে। তাই সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দিয়েছি। এ ব্যাপারে কোনো আশানুরূপ ফল পাইনি।
ড. মহিউদ্দিন জানান, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বলছে, এমআরএনএ টিকা বানরের ওপর প্রয়োগের দরকার নেই। কিন্তু বিএমআরসি এটি করার কথা বলছে। তাই বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুসরণ করে বন বিভাগের অনুমোদন নিয়ে বানর সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
গ্লোব বায়োটেক সূত্রে জানা গেছে, ‘বঙ্গভ্যাক্স’ উৎপাদনের এ টিকা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১ মাস এবং ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। এটি সিন্থেটিক্যালি তৈরি হওয়ায় ভাইরাসমুক্ত এবং শতভাগ হালাল।
২০২০ সালে জুলাই মাসে ওষুধ প্রস্তুতকারী গ্লোব ফার্মার সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক ‘বঙ্গভ্যাক্স’ টিকা তৈরির কাজ শুরুর কথা জানায়। গত বছরের ১৫ অক্টোবর গ্লোব বায়োটেকের আবিষ্কৃত এমআরএনএ ভ্যাকসিনকে কোভিড-১৯ টিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরে ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল বঙ্গভ্যাক্সের গবেষণাগার পরিদর্শন করে সব তথ্য-উপাত্ত ও প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নথিপত্র পর্যালোচনা শেষে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অগ্রগতিতে সহযোগিতা করে। পরবর্তী সময়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ওই গবেষণাগার ও উৎপাদনকেন্দ্র পরিদর্শন সাপেক্ষে গত ২৮ ডিসেম্বর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য ‘বঙ্গভ্যাক্স’ উৎপাদনের অনুমতি দেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্লোব বায়োটেক প্রথমে টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য একটি কনট্র্যাকট রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিআরও) সঙ্গে কাজ করে। তারা গবেষণাকেন্দ্র ও ভ্যাক্সিন কার্যক্রম দেখে প্রশংসা করলেও তাদের ফেজ-১ ও ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় পরবর্তীকালে ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে টিকার ফেজ-১ ও ফেজ-২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের জন্য বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদে (বিএমআরসি) চলতি বছরের ১ জানুয়ারি প্রটোকলসহ আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। বিএমআরসির ইথিক্যাল কমিটি প্রোটোকল পর্যালোচনা করে প্রায় শতাধিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ শেষে এ বছরের ২ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি দেন এবং সংশোধিত প্রোটোকল ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএমআরসিতে জমা দেওয়া হয়।
গত ১৮ মে বঙ্গভ্যাক্সের গবেষণাপত্রটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ মেডিকেল জার্নাল ভ্যাকসিনে প্রকাশিত হয়। এরপর ৫ মাস পর গত ২২ জুন বিএমআরসি দিয়ে জানায়, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আগে বানর অথবা শিম্পাঞ্জির ওপর প্রয়োগ করতে হবে। তারপরই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
এ ব্যাপারে গ্লোব বায়োএনটেকের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সময়ের আলোকে বলেন, আমরা সরকারের সম্পূর্ণ সহযোগিতা এবং ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি পেয়েছি। কিন্তু বিএমআরসির কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। এই ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে বা এর অনুমোদন পেতে যেন দেরি হয় এবং এটি যাতে আলোর মুখ না দেখে, এজন্যই বিএমআরসি এসব শর্ত জুড়ে দেয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৪ জুলাই বঙ্গভ্যাক্স টিকার ট্রায়ালের জন্য গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমীর জঙ্গল থেকে বানর ধরতে গিয়ে গ্লোব বায়োএনটেকের কর্মকতারা স্থানীয়দের রোষের মুখে পড়েন। এ সময় তাদের বেশ কয়েকজন কর্মীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। যদিও তারা সরকারি অনুমতি নিয়ে বানর ধরতে গিয়েছিলেন।