আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে আমার কলামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি টিকে থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমি আলোচনা করেছি। তাতে বিএনপি নেতারা দারুণ ক্ষুণ্ণ হয়েছেন এবং স্বনামে-বেনামে আমাকে ফেসবুকে নিন্দামন্দ করেছেন। আমার আলোচনাটি নিয়ে তারা পালটা আলোচনা করতে পারতেন। তা তারা করেননি। বিএনপি কখনোই সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। এখন ক্ষমতায় নেই বলে আমার কল্লা নিতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকলে হয়তো নিত। নিদেন নেওয়ার চেষ্টা করত। এজন্যে মিত্র জামায়াতের ঘাতক বাহিনী তো তাদের দলেই ঘাপটি মেরে রয়েছে।
আমি কোনো সাম্প্রদায়িক দলের শুভাকাঙ্ক্ষী নই। সে জন্যে বিএনপিরও শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারিনি। তাই বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির বিলুপ্তি আমি চাই না। তার কারণ, গণতন্ত্রের জন্যই বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। কিন্তু সে দলকে হতে হবে আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি গণতান্ত্রিক দল। আজ বিরোধী দল হিসেবে থাকবে। কাল ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বৈশিষ্ট্য, গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত রাখবে। দল হিসেবে তারা আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির বিরোধিতা করবে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক জাতীয় রাজনীতির মূলধারার বিরোধিতা করবে না।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতায় এসে শুধু আওয়ামী লীগকেই ধ্বংস করতে চাননি, স্বাধীনতার আদর্শ এবং তার মূলধারাকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দল ক্ষমতায় এসে শুধু আওয়ামী লীগের নাম নিশানা নয়, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, একটি মুক্তিযুদ্ধ দ্বারা অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিটি কাঠামো ভাঙার চেষ্টা করে আজ সামুদ্রিক ঝড়ে বিধ্বস্ত রণপোতের মতো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ দলের নেত্রী এবং ভারপ্রাপ্ত নেতা দু’জনেই গা-ঢাকা দিয়েছেন এবং দলের হতাশ নেতাকর্মীরা হা মাতম হা মাতম করছেন।
আমি বর্তমান বিএনপির এই অবস্থা নিয়ে পত্রিকান্তরের লেখায় আলোচনা করেছি এবং বিএনপি কি করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করেছি। আমার মতে, বিএনপি যদি জামায়াত ও তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ বর্জন করে আবার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে (তারেকের নেতৃত্বে নয়) তার হারানো গণতান্ত্রিক চরিত্রে ফিরে যায় এবং স্বাধীনতার মূল আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতা এবং ৭২-এর সংবিধানের (অবিকৃত) আনুগত্য ঘোষণা করে, তাহলে দলটি শুধু টিকে থাকবে না, আওয়ামী লীগকে হটিয়ে একদিন ক্ষমতায় যেতে পারবে। নইলে ভারতের এককালের মহাশক্তিশালী দল হিন্দু মহাসভার মতো বিএনপির অস্তিত্ব লুপ্ত হবে। আমি আরও লিখছি, এই মুহূর্তে খালেদা জিয়া বিএনপির ঐক্যের একমাত্র সূত্র। তাকে নেতৃত্বে রাখা হলে দল টিকবে। তাকে সরিয়ে তারেক রহমান বা অন্য কাউকে নেতৃত্বে আনা হলে দলটিতে ভাঙন অনিবার্য।
এই আলোচনাটি করে কি আমি অন্যায় করেছি? বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির বিলুপ্তি কামনা করলে তার বাঁচার পথের কথা নিশ্চয়ই আলোচনা করতাম না। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ‘আক্কেলের’ পরিমাণ এতো কম যে, ভালো কথা শোনালেও তারা গরম হয়ে ওঠেন এবং ডনকুইজ জোটের মতো খোঁড়া অশ্বে সওয়ার হয়ে যুদ্ধযাত্রা করেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং অর্থনীতিতে এমন একটা মোড় ঘুরিয়েছেন যে, বিদেশের অনেকেই এখন বাংলাদেশের দিকে চোখ ফিরিয়েছেন। তাদের মধ্যে সাদা সাহেব সাংবাদিকও অনেক আছেন। লন্ডনে তাদের একজন বাংলাদেশ ঘুরে এসে আমাকে বললেন, শেখ হাসিনা দেশটির খুব উন্নতি ঘটিয়েছেন। তথাপি পিপলের মধ্যে ডিসকন্টেন্ট আছে। সামনের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি বর্তমান ভাঙা অবস্থাতেও জিতে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
তার ধারণা, ভারতে গণতন্ত্রের স্ট্রং ভিত্তি এবং একটি শক্তিশালী অসাম্প্রদায়িক এলিট ক্লাস থাকা সত্ত্বেও বিজেপির মতো একটি কট্টর সাম্প্রদায়িক দল এবং নরেন্দ্র মোদির মতো ব্যক্তির ক্ষমতায় আরোহণ সম্ভব হয়েছে এবং দেশটি গোঁড়ামিপূর্ণ কট্টর হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকেছেন, তেমনি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের স্ট্রং ভিত্তি এবং এলিট ক্লাসের একটি ক্ষুদ্র অংশের অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটবে। সাহেব সাংবাদিকের আরও ধারণা, আমরা চাই বা না চাই, একুশ শতক হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, রেসিজম ও ফ্যাসিজমের উত্থানের যুগ। আমেরিকায় তাই বর্ণবাদী ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছে। রাশিয়ায় স্ট্যালিনিস্ট পুতিন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং চীন মুখে কমিউনিজমের কথা যতই বলুক, তার মূলনীতি হচ্ছে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও পুঁজিবাদী সম্প্রসারণবাদ। উপমহাদেশেও ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং বাংলাদেশে উগ্র ইসলামিস্টদের জয়জয়কার ঘটবে। পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সামরিক জান্তা আবার ক্ষমতাশালী হবে।
আমি সাহেব সাংবাদিকের এই বিশ্নেষণের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত প্রকাশ করিনি। আমি তাকে নিজের বিশ্নেষণ জানিয়েছি। বলেছি, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো স্ট্রং এবং পপুলার নেতৃত্ব নেই। এটাই আওয়ামী লীগের সব চাইতে বড় সম্পদ। আগামী সাধারণ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ হয় তো যে কোনো পরিস্থিতিতে জয়ী হবে বলে আমি আশাবাদী। বিএনপি বিপর্যস্ত দল। নেতৃত্ব নেই। এই বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের নামে ভাড়া করে যেসব নেতাকে দলে টানা হয়েছিল, দেখা গেল নাটকে মৃত সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই।
তবু আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে পরাজিত হয়, তাহলে বিএনপির জনপ্রিয়তার জন্য সেই পরাজয় হবে না। পরাজয় হবে আওয়ামী লীগ দলের প্রতি বিমুখ মেজরিটি ভোটারের প্রোটেস্ট ভোটের জন্য। জনসাধারণ বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। কারণ, তাদের চুরি দুর্নীতি তারা দেখেছে। তবু তারা আওয়ামী লীগের চুরি দুর্নীতির একই কারণে দলটির বিরুদ্ধে প্রোটেস্ট ভোট দেবে। তাতে বিএনপি উপকৃত হবে। এই সত্যটা আওয়ামী লীগের বর্তমান মন্ত্রী, এমপির অধিকাংশই বুঝতে চাইছেন না অথবা পারছেন না। দলে নব্য আওয়ামী লীগার সেজে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ বিস্তর। শেখ হাসিনা কতদিক সামলাবেন। তার পরিবারের কিছু সদস্যও তার জন্য বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ যদি সময় থাকতে নিজেকে সংশোধন না করে, দল থেকে দুর্নীতিবাজদের না তাড়ায় তাহলে বিএনপির জনপ্রিয়তার জন্য নয়, আওয়ামী লীগের
নিজের দোষে আগামী নির্বাচনে দলটির বিপর্যয় ঘটতে পারে।
তবে সেক্ষেত্রেও একটি কথা আছে। বর্তমান বিশ্বে উন্নত-উন্নয়নশীল কোনো দেশেই খাঁটি গণতন্ত্র নেই। সেটা হোক আমেরিকা, কিংবা ব্রিটেন ও ফ্রান্স, এমনকি চীন ও রাশিয়া সর্বত্রই রাষ্ট্র ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর একটা নেপথ্য ভূমিকা রয়েছে। এটা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয় না। একটা গল্প বলি। কোনো ব্যক্তি বা কোনো দেশের প্রতি এটা অসম্মান দেখানো নয়। এটা নিছক বানানো গল্প। ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য ইন্ডিয়া থেকে আসা এক যুবক ঠিক করল, সে ইউরোপে বিয়ে করবে না। তার ধারণা, ইউরোপের মেয়েরা বিয়ে পর্যন্ত কুমারী থাকে না। সে ইন্ডিয়ায় ফিরে গেল। কিন্তু ইন্ডিয়ায় ফিরে গিয়ে দেখে সেখানেও কুমারী মেয়ে নেই। আমরাও এই একুশ শতকে যে কুমারী গণতন্ত্র চাই (যে কুমারী গণতন্ত্রের জন্য ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড কোং অহরাত্র চিৎকার করেন) তা এখন বিশ্বের কোথাও নেই।
আগে নব্য ধনী, ক্যান্টনমেন্ট, আমলাতন্ত্র সকলের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছে বিএনপি। তাই খালেদা জিয়ার পক্ষে ক্যান্টনমেন্টে বসে ক্ষমতা পরিচালনা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনার সাফল্য এই যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রাদর্শ থেকে সরে এসে সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক (পাকিস্তানপ্রেমিক নয়) নতুন প্রজন্ম, নব্য ধনী শ্রেণির একটা বড় অংশ এবং আমলাতন্ত্রের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছেন। বিএনপি এখন এই সমর্থন হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। বেগম জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে তাড়ানোও এ জন্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
ভারতেও বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বিশাল বিগ বিজনেস, বিগ মিডিয়ার সমর্থন পেয়ে। পেছনে বিদেশি সাহায্যও ছিল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মোদি-হাওয়া। মোদিবিহীন বিজেপির জনপ্রিয়তা খুব কম। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার আরেকটি বড় সাফল্য আমেরিকার চিরাচরিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা ঠেকানো এবং তাকে নিরপেক্ষ করা এবং ভারতের শাসক দলের এমনকি বিজেপিরও সমর্থন আদায়। এখানেই বিএনপি শেখ হাসিনার কাছে বড় মার খেয়েছে। বিএনপিতে যদি খালেদা জিয়ার পরিবর্তে তারেক রহমানকে দলের নেতা করা হয় তাহলে দলটি সামরিক বাহিনীর সমর্থন পাবে কিনা সন্দেহ। কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে তারেক রহমানের দুর্বিনীত ব্যবহার, বেয়াদপি এবং সম্ভবত তাদের বিজনেস প্রোফিটে ভাগ বসানো ইত্যাদি তার কারণ। এ জন্যে এক-এগারোর সময় জেলে থাকাকালে সামরিক বাহিনীর কতিপয় অফিসারের হাতে তারেককে উত্তম-মধ্যম খেতে হয়।
সুতরাং আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা হারালেও বিএনপি দলকে বর্তমান অবস্থায় রেখে চিচিং ফাঁক করে নির্বাচনে জিতে যাবে তার সম্ভাবনা কম। আবার আওয়ামী লীগও যদি তাদের বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্ত না হয়, আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা তাদের বিরুদ্ধে মানুষের মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অভিযোগ দূর না করেন তাহলে কেবল শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন সে সম্ভাবনা কম। গত নির্বাচনের মতো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যাতে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রার্থী জাতীয় সংসদে বেশিরভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আসবেন, সে সম্ভাবনা আগামী নির্বাচনে একেবারেই নেই।
এক কথায় আগামী নির্বাচনটি যথাসময়ে হলে দুটি বড় দলের মধ্যে প্রকৃত যুদ্ধ হবে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলে নির্বাচনে জনগণের সমর্থন কতটা পাবে তাতেও আমার সন্দেহ আছে। দেশের রাজনীতিতে একটা ডেডলক সৃষ্টি হতে পারে। বিএনপি যে স্বপ্ন দেখছে, দলের পুনর্গঠন ও নীতি পরিবর্তন ছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থার সুযোগ নিয়ে তারা চিচিং ফাঁক বলেই ক্ষমতায় যেতে পারবে, সে আশার গুড়েবালি। নির্বাচনে জয়-পরাজয় শুধু সাধারণ ভোটদাতাদের দ্বারা নির্ধারিত হবে না, নেপথ্যের শক্তিগুলোর সমর্থনও দরকার হবে। সে সমর্থন ছাড়া বিএনপি কোনোদিনই ক্ষমতায় যেতে পারবে না। বর্তমান দলীয় অবস্থায় সে সমর্থন আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সম্ভব না হলে তাকে ভারতের হিন্দু মহাসভার মতো বিলুপ্ত হতে হবে। এই সতর্ক বাণীটা বিএনপিকে জানিয়ে আমি কি অন্যায় করেছি? আমাকে নিন্দামন্দ করে বিএনপি কি তার ভাঙা কপাল জোড়া লাগাতে পারবে?