1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন ও বাংলাদেশ

ড. ফরিদুল আলম : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩

গত ১২ ও ১৩ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ষষ্ঠ ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন। ২৫টি দেশের প্রায় ৩০০ অংশগ্রহণকারী দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে অংশ নেন। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতি বলতে আমরা বর্তমানে যা বুঝি তা হলো বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে যেমন আগামী দিনগুলোতে বিশ্বরাজনীতির মানচিত্রে এক ধরনের দৃশ্যমান পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, অন্যদিকে কভিড-১৯ পরিস্থিতি পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতেও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন আধিপত্যের লড়াই এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। যে চীন থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছিল, সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়লেও চীন কিন্তু নিজেকে ঠিকই সামলে নিয়েছে। পক্ষান্তরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিকে এক বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে, যা খুব দ্রুত সামলে নেওয়া কষ্টকর বিষয়। এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে নতুন সমীকরণ চলছে, বিশেষ করে অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে না পারলে যে রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়ানো সম্ভব হবে না, সেই উপলব্ধিবোধ থেকে বড় শক্তিগুলোর এক অন্য রকম তৎপরতা চলছে। চীনের নেতৃত্বে গত কয়েক বছরে বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) যখন অনেকটাই কাঠামোগত আকৃতি পেয়েছে, এই অবস্থায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মাধ্যমে চীনের ভবিষ্যৎ আধিপত্যকে রুখে দেওয়ার প্রচেষ্টাও চলমান। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ক্ষেত্রেও এক নতুন মেরুকরণ ঘটতে যাচ্ছে, যার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নের আলোচনায়, যেখানে নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছে চীন। এসব কিছুকে ছাপিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যদি একটু নিজেদের দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে ক্রমেই বিশ্বের মনোযোগের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। সদ্যঃসমাপ্ত ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বড় শক্তিগুলো এখন আর বাংলাদেশ বা অন্য ক্ষুদ্রতর দেশগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক অংশীদারির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলায় সমন্বিতভাবে কাজ করাকেই শ্রেয় মনে করছে।

এবারের সম্মেলনের প্রথম দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মধ্যে মরিশাসের প্রেসিডেন্ট, মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ২৫ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারত সরকারের এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের অনেক নীতিনির্ধারক উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারি গড়ে তোলার পাশাপাশি এ অঞ্চলে বিদ্যমান সামুদ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার আহ্বান জানান। ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, অংশীদারি এবং সমৃদ্ধি’ প্রতিপাদ্যে আয়োজিত ষষ্ঠ ‘ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলন ২০২৩’-এ অংশ নিয়ে শেখ হাসিনা ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাবগুলো হলো—প্রথমত, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘সমুদ্র কূটনীতি’ জোরালো করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ অঞ্চলের অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি বিবেচনা করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং তত্সংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের সহযোগিতা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, একটি স্থিতিশীল এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমীহের ভিত্তিতে শক্তিশালী অংশীদারি গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে বলেন, ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিদ্যমান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যার মধ্যে সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়া, অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌ ও বিমান চলাচল নিশ্চিত করা হবে। পঞ্চমত, ‘শান্তির সংস্কৃতি’ চর্চা এবং জনবান্ধব উন্নয়নের প্রসার করতে হবে। একটি শান্তিপূর্ণ, সমতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে বিশ্বজনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী সম্প্রদায়কে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ষষ্ঠত, উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রসার করা, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলে এবং তার বাইরেও সমতাভিত্তিক টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।

আমরা যদি একটু খেয়াল করে দেখি, তাহলে বুঝতে পারব এবারের এই সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলোকে যদি আমলে নেওয়া হয়, তাহলে এই অঞ্চলের অপরাপর দেশগুলোর প্রভূত উন্নতি সাধনের সম্ভাবনা যেমন আছে, এর পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবসহ অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকিগুলো সমন্বিতভাবে মোকাবেলা করে নিজেদের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে এক বড় অগ্রগতি সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এই সম্মেলনের আয়োজক মূলত ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন, যাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকারের সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংস্থা (আরএসএস)। এটি উল্লেখ করছি এ কারণে যে সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক যে দলটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভারত যেহেতু এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, সে ক্ষেত্রে তাদের দিক দিয়ে রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণকারী অপরাপর দেশগুলোর কাছে এই বার্তাটি পরিষ্কার করে দেওয়া যে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে পারস্পরিক অংশীদারির বিকল্প নেই।

এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও এই সম্মেলন ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদারির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কি না, সেটি নিয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে ধারণাগুলো পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে এই মর্মে যে বিশ্বের অনেক উন্নত রাষ্ট্র কর্তৃক নেতিবাচক প্রভাবকে মোকাবেলা করতে একযোগে কাজ করতে চায় ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলো। আর এ ক্ষেত্রে সংগত কারণেই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বা কোয়াডের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক থাকার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘বিশ্বজনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ মানুষের বাস এই অঞ্চলে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এই অঞ্চলের অবদান ৬০ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে আমরা এটিকে দেখতে পারি এমন একটি সম্মিলন হিসেবে, যার মধ্য দিয়ে উন্নত দেশগুলোকে শক্ত করে একটি বার্তা দিয়ে রাখা যে ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর কার্যকর অংশগ্রহণের স্বীকৃতি না দিলে ভবিষ্যতে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর জন্য টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।

দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের সমাপ্তি দিনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে, ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স (আইওসি) ২০২৩ আয়োজনের অংশীদার হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত হয়েছে।’ সম্মেলনটির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, এই আয়োজনের মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভারত মহাসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলোসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারি সুদৃঢ় হয়েছে। সম্মেলনটি ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোকে নিয়ে আয়োজন করা হলেও এই ফোরামে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরাও এটি বলতে পারি যে এমন একটি সময়ে এই সম্মেলন বাংলাদেশে আয়োজন করা হয়েছে এবং অপরাপর অংশগ্রহণকারী দেশগুলোও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে  ভারত মহাসাগরের অন্যতম কেন্দ্রের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ছে ধীরে ধীরে।

বিশ্বরাজনীতিতে বড় দেশগুলোর মধ্যে শক্তির প্রতিযোগিতার এই সময়ে এসে এ ধরনের আয়োজন সুস্পষ্টভাবে উন্নত দেশগুলোর কাছে এক ধরনের বার্তা হিসেবে দেখা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে এটি বোঝানোর একটি প্রয়াস যে ভবিষ্যৎ বিশ্বব্যবস্থাকে নিরাপদ করতে উপকূলীয় দেশ, বিশেষত ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নত দেশগুলো যদি নিজ থেকে সহযোগী না হয়, তাহলে উপকূলীয় এই অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নিজেদের সব সংকট থেকে রক্ষা করার সামর্থ্য রয়েছে, এটি উপলব্ধি করা এক বড় অর্জন। এই সম্মেলনে সব দেশ এই মর্মে একমত হয়েছে যে বিশ্ববাণিজ্যের শতকরা ৯০ ভাগই পরিচালিত হয় সমুদ্রপথে এবং গত ১৫ বছরে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় তিন গুণ। সব দিক বিবেচনায় ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে আরো সুসংহত করতে এবারের সম্মেলনটি এক পথরেখা হয়ে থাকবে।

লেখক: ড. ফরিদুল আলম – অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - রাজনীতি