1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাজেটে তামাক পণ্যে কার্যকর কর আরোপ বহুমুখী সুফল নিয়ে আসবে

অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২৫ মে, ২০২২
ড. আতিউর রহমান

আগের দুটি বাজেট (২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছর) এক অর্থে ছিল দুর্যোগ মোকাবিলার দলিল। মহামারী চলমান থাকা অবস্থায় প্রস্তুত করা হয়েছিল এ দুটি বাজেট। তাই সেগুলোকে গতানুগতিক বাজেটের চেয়ে বেশখানিকটা ব্যতিক্রমীই বলা চলে। করোনা মহামারী মোকাবিলা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যগুলো সামনে রেখে সে সময় যে দুটি বাজেট সরকার দিয়েছিল, এগুলোকে বিশেষজ্ঞরা স্বাগতই জানিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে দিন শেষে এগুলোর সুফল দেশের সবস্তরের মানুষ পেয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এগুলোর ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। করোনা মোকাবিলার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বাস্তব শিক্ষা বাজেট প্রণেতাদের হয়েছে। তাই সংকট কাটিয়ে দেশের অর্থনীতিতে আবার নতুন প্রাণসঞ্চারের জন্য একটি সম্প্রসারণমুখী বাজেট আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য হবে- এমনটি অনেকেই আশা করছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই অনাকাক্সিক্ষতভাবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেছে।

এই বৈশ্বিক অস্থিরতার জেরে জ্বালনি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, জাহাজ পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় অনেক খাদ্য রপ্তানিকারক দেশের সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ ইত্যাদি মিলিয়ে এক ভয়াবহ সংকটেই পড়েছে পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। হঠাৎ করে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ সরকারের ন্যায্যমূল্যে খাদ্যপণ্য সরবরাহের সময়োচিত উদ্যোগের কারণে কিছুটা সামাল দেওয়া গেছে। তবে বাড়তি আমদানি ব্যয়ের কারণে বৈদেশি মুদ্রার চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতির কারণে চলতি হিসাবেও বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাবে সার্বিক লেনদেনেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে একদিকে টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে গিয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড়তে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে, অন্যদিকে রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বর্হিঅর্থনীতি বড় সংকটে পড়ে গেছে বলে একদল সমালোচক শোরগোল শুরু করে দিয়েছেন। আমি বলছি না যে, অর্থনীতিতে কোনো সমস্যাই নেই। কিন্তু এ কথাও মানতে হবে, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্যও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নিতে শুরু করেছে। আমদানি ব্যয় কমানোসহ সব কম অগ্রাধিকারের কাজে ডলার ব্যয়ের ওপর একে একে নিষেধাজ্ঞা এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি ডলার সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য নিয়মনীতি সহজ করাসহ বেশকিছু নীতি সক্রিয়তাও চোখে পড়ছে।

এই কঠিন পরিস্থিতিতে আসন্ন অর্থবছরে সরকার কেমন বাজেট দেয়, তা দেখার অপেক্ষায় আছেন বিশেষজ্ঞসহ সাধারণ মানুষও। এই প্রেক্ষাপটে আগামী ৯ জুন যে বাজেট মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে, সেখানে তামাক পণ্যের ওপর কার্যকর করারোপের বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, চলতি অর্থবছরের বাজেট ২০২১ সালের জুনে সংসদে উত্থাপনের আগে থেকেই তামাকবিরোধী সচেতন অংশীজনদের পক্ষ থেকে তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের যৌক্তিক প্রস্তাবনা সবিস্তারে হাজির করা হয়েছিল। প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে নীতি সংলাপ আয়োজনসহ বিভিন্ন উপায়ে সংসদ সদস্য ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ওই নীতি-প্রস্তাবনাগুলো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে প্রতিফলিত হয়নি। করোনা সংকট মোকাবিলা নিয়ে চাপে থাকায় নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়টিতে হয়তো অতটা মনোযোগ দিতে পারেননি। তবে আশার কথা এই যে, ওই ২০২১ সালের বাজেট অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা যেমন বারবার তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছিলেন, একই রকম ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তরফ থেকেও। তাই তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠনগুলো দেশি-বিদেশি গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে পরের অর্থবছরের জন্য (অর্থাৎ আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য) আবারও তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। শুধু তা নয়, এই প্রস্তাবনাগুলোর পক্ষে যৌক্তিকতা এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এগুলো প্রযোজ্য কিনা, তা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও তথ্যও যুক্ত করা হয়েছে।

এবার তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের প্রস্তাবনায় নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম- এই চার স্তরের সিগারেটেরই ঘোষিত সর্বনিম্ন খুচরা মূল্য যথাক্রমে ২৮, ১৯, ১৮ ও ১১ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম সর্বোচ্চ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট যে সিগারেট বিক্রি হয়, এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই নিম্নস্তরের সিগারেট। কর কাঠামোতেও বড় সংস্কারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বর্তমানে সিগারেটের খুচরা বিক্রয় মূল্যের ওপর শতাংশ হিসেবে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়ে থাকে। এবার এর পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হচ্ছে। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য উদাহরণ দেওয়া যায়। বর্তমানে নিম্নস্তরের দশ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের সর্বনিম্ন ঘোষিত খুচরা মূল্য ৩৯ টাকা। আর এর ওপর ৫৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা আছে। অর্থাৎ ৩৯ টাকার ৫৭ শতাংশ হিসাবে সম্পূরক শুল্ক প্রদেয় হয় ২২ টাকার কিছু বেশি। কিন্তু নতুন প্রস্তাবনায় এই ঘোষিত সর্বনিম্ন খুচরা মূল্য ৫০ টাকা করে তা থেকে শতাংশ হিসাবের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৩৩ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ঘোষিত খুচরা মূল্যের ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আগের মতোই বহাল রাখা হচ্ছে। এতে দশ শলাকার এক প্যাকেট নিম্নস্তরের সিগারেট থেকে আগে যেখানে ২৮ টাকার কিছু বেশি মোট রাজস্ব হিসাবে সরকারের কোষাগারে যেত, এখন ওই রাজস্বের পরিমাণ বেড়ে হবে প্রায় ৪১ টাকা। শতাংশ হিসাবের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা গেলে প্রথমত, কর কাঠামো সহজীকরণের ফলে রাজস্ব আহরণের দক্ষতা বাড়বে। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব প্রাক্কলন করা সহজ হবে এবং সর্বোপরি প্রতিবছর মুদ্রাস্ফীতি ও বর্ধমান আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্পূরক শুল্ক ‘রিভাইস’ করা যাবে।

সিমুলেশনের মাধ্যমে আমাদের গবেষকরা দেখিয়েছেন, সিগারেটের ওপর কার্যকর করারোপের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হলে আগামী বছর সিগারেট ব্যবহার ছেড়ে দিতে পারেন ১৩ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক। আর ৯ লাখ তরুণ সিগারেট খাওয়া শুরু করা থেকে বিরত থাকবেন। আর দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ৯ লাখ অকালমৃত্যুও রোধ করা যাবে। তবে এগুলো আঁচ-অনুমান। এসব স্বাস্থ্যগত সুফলের অর্থনৈতিক ইতিবাচক প্রভাবগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের ষষ্ঠ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসছে নাগরিকদের পকেট থেকে। আর সরকারের তরফ থেকে আসছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কাজেই সিগারেট ব্যবহার কমায় ধূমপানজনিত রোগের প্রকোপ এবং সে সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় কমলে জনগণের পকেটের টাকা যেমন বাঁচবে, তেমনি একইভাবে স্বাস্থ্যসেবা বাবদ সরকারের ব্যয়ও কমবে। আগামী অর্থবছরে যে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পরিকল্পনা আমরা করছি, এর প্রেক্ষাপটে এই অর্থ সাশ্রয় নিশ্চয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

এবারের তামাক পণ্যে কার্যকর করের প্রস্তাবনাগুলো রাজস্ব আহরণে যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সেটিও তুলে ধরা যায়। এই যে বিভিন্ন স্তরের সিগারেটের ওপর বিভিন্ন হারে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবনা রাখা হচ্ছে, এর পেছনে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এবারের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়িত হলে সিগারেটের ব্যবহার কমবে ঠিকই তবে এতে সিগারেট থেকে আসা রাজস্ব কমবে না, বরং অতিরিক্ত ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব হতে পারে সিগারেট বিক্রি থেকে। অর্থ বিভাগের প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, আসন্ন অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, এই বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ কেবল সিগারেটের ওপর কার্যকর করারোপ থেকেই আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, সিগারেটের মতো অন্যসব তামাক পণ্যেরই ন্যূনতম ঘোষিত খুচরা মূল্য বাড়িয়ে এর ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তাই বলা যায়, সব প্রস্তাবনার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলে প্রকৃত সুফল বেশি হওয়া সম্ভব।

পরিশেষে আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো যে, আমাদের দেশে সিগারেটের উৎপাদন ব্যয় নিতান্ত কম হওয়ায় উচ্চহারে করারোপের পরও এগুলোর বিক্রয় মূল্য অন্য অনেক দেশের চেয়ে কম থেকে যাচ্ছে। সিগারেটের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির একটি উপায় হতে পারে- এর জন্য যে ইনপুট সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেগুলোর ওপর কর বৃদ্ধি করা। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানি নিরুৎসাহিতকরণের যে নীতি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাস্তবায়ন করছে, এর সঙ্গেও এটি সঙ্গতিপূর্ণ। এগুলো নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, একই সঙ্গে আসন্ন অর্থবছরে তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের নাগরিক আন্দোলনটিও এগিয়ে নিতে হবে। কারণ তামাক পণ্যে কার্যকর করারোপের যে বহুমুখী সুফল, সেগুলো স্বল্পমেয়াদে যেমন আমাদের জন্য দরকারি- তেমনি দীর্ঘমেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনের জন্যও কার্যকর পদক্ষেপ। আসন্ন বাজেট ঘিরে তামাকে বাড়তি করারোপের বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাক- এ প্রত্যাশাই করছি।

লেখক : অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান – বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয় সভাপতি


সর্বশেষ - রাজনীতি

নির্বাচিত