1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বৈশাখ থেকে ঈদ ও আমাদের উৎসবের অর্থনীতি

অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৩
অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস

পর পর দুটি উৎসব। প্রথমটি সব বাঙালির জন্য পহেলা বৈশাখ। দ্বিতীয় উৎসবটি মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদ। এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে উপস্থিত হয় খুশির এই দিন। এক মাস সাহরি খাওয়ার পর থেকে ইফতার অবধি উপোস থেকে ঈদের দিন সেই রোজার পরিসমাপ্তি ঘটে আনন্দের বন্যায়। কবি নজরুলের কথায়, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ…।’

অর্থনীতির ওপর ঈদের বা পহেলা বৈশাখের প্রভাব সম্পর্কে কিছু বলার আগে ঈদ উৎসবের একটা বিশেষ দিক বিবেচনার দাবি রাখে। ঈদের সামাজিক দিকটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিকটা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে কবি নজরুল ইসলামের গানে। প্রথমত, রোজা ও ঈদের সময় যাদের কিছু নেই সেই দরিদ্রের প্রতি সমব্যাথি হওয়া দায়িত্বের মধ্যে এসে পড়ে এবং সেই সূত্রে জাকাত-ফিতরা প্রদান করে তাদের জন্য সাহায্যের হাত প্রসারিত করা (যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী/সেই গরিব, ইয়াতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফীদ)। এককথায় রোজার বা ঈদের তাগিদ হচ্ছে বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালানো। দ্বিতীয়ত, ঈদ মানে কোলাকুলি, ঈদ মানে একে অপরকে হাসিমুখে বরণ করা (আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে/তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ)। এবং সব শেষে ঈদ মানে পারিবারিক বন্ধন বৃদ্ধি। শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটে যাওয়া। ঈদ মানে সন্তানের জন্য মায়ের তীব্র প্রতীক্ষা, ঈদ মানে স্বজনের জন্য কেনাকাটা, ঈদ মানে একে অপরের ঘরের রান্না খাওয়া।

আমার মতো ‘অবসরপ্রাপ্ত’ একজন অধ্যাপক সদাশয় সরকারের কাছ থেকে উৎসব উদযাপনের জন্য ভাতা পেয়েছেন সর্বমোট ৪২ হাজার ১২০ টাকা (বৈশাখী ভাতা সাত হাজার ২৫ টাকা+ঈদ বোনাস ৩৫ হাজার ১০০ টাকা)। অর্থনীতির প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা (অর্থাৎ অতিরিক্ত ১০০ টাকা হাতে এলে ওই টাকার কতটুকু ব্যয় করা হয়) আমাদের দেশে গড়পড়তা প্রায় ০.৬, অর্থাৎ ১০০ টাকা অতিরিক্ত হাতে পেলে ৬০ টাকা বাজারে খরচ হিসাবে চলে যায় এবং উৎসবের কালে ‘ইদি’ ও অন্যান্য খরচে ভর করে তা আরো একটু বেশি উঠতে পারে। এটা হচ্ছে ব্যয়ের ব্যারোমিটার বা পারদ। নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র শ্রেণির জন্য এই প্রবণতা ০.৮-এর কম হবে বলে মনে হয় না, এমনকি ওপরেও উঠতে পারে। বাংলাদেশে মোট সরকারি চাকরিজীবী ১৩ লাখ ধরলে শুধু তাঁদের হাতে গেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা এই দুই উৎসবের ভাতা হিসেবে। তার সঙ্গে আছে আমার মতো অবসরপ্রাপ্ত বেকার (সংখ্যা জানা নেই) হাজারে হাজার। অন্যদিকে অনুমান করি উৎসব উপলক্ষে ব্যক্তি খাতেও মাথাপিছু প্রায় সমপরিমাণ অর্থ যায়। ধরে নেওয়া ভালো যে খুব কৃপণ ছাড়া কেউ বৈশাখী ভাতা কিংবা ঈদ বোনাস জমান না, বরং পারেন তো এর ওপর হাওলাত করে উৎসবের আমেজে থাকতে পছন্দ করেন। অর্থনীতিবিদরা সংস্কৃতির এ অংশটুকু প্রায়ই পরিহার করে থাকেন বলে যত বিপত্তি।

তবে এসব হিসাব একেবারে গরিবকে বাদ দিয়ে নয়। উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র জনগণ অন্তত মুখ বাঁচানোর জন্য বিয়ে, যৌতুক, উৎসবে বেশ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে থাকে। ভারতে বিয়ের খরচ সবাই জানে, তার পরও এর চেয়ে কম আনন্দদায়ক অনুষ্ঠানে অর্থ ঢালতে হয়। নোবেলজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি মরক্কোর এক গরিবকে, যার পরিবারে যথেষ্ট খাদ্য নেই, জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে আরো টাকা দিলে কী করবেন? লোকটি উত্তর দিল, খাবার কিনব। যদি আরো দিই? লোকটি বলল, সুস্বাদু খাবার কিনে খাব। আরো বেশি দিলে? লোকটি বলল, একটা টিভি কিনব। অভিজিৎ প্রশ্ন রাখলেন যথেষ্ট খাবার নেই ঘরে, তাহলে টিভি কেনা কেন? লোকটি তখন হেসে বলল, খাবারের চেয়ে টিভি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে উৎসবের বেলায় গরিব ধনীর মতোই হাত খুলে সাধ্যমতো খরচ করে।

সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির ফলে যে একটা তেজি ভাব বা ‘বুম’ আসছে তা বলাই বাহুল্য। বিশেষত বাজারে ঈদুল ফিতরকেন্দ্রিক বুম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ব্যবসায়ীদের আন্দাজ থেকে বলা যায়, এই দুই উৎসবে সর্বমোট দুই লাখ কোটি টাকার বাজার বা ঈদ অর্থনীতি বিস্তৃতি লাভ করতে যাচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকার হিসাবে এই অঙ্ক আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা! সুতরাং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে কালো মুখের ব্যবসায়ীরা আলোর মুখ দেখবেন এটাই তো প্রত্যাশিত, তাই না?

উৎসবের অর্থনীতির অন্য এক উজ্জ্বল দিক হলো রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া। শোনা যায় মার্চ মাসে বিদেশ থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ২০২ মিলিয়ন ডলার) এসেছে, যা গেল সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রাপ্ত এই অর্থের বেশির ভাগ যে ভোগে ব্যয় হবে, তা বলাই বাহুল্য। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এমনিতে প্রবাস আয়ের বড় মাপের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, ঈদের সময় সেটা আরো তেজি ভাব ধারণ করে।

কোনো কোনো ব্যবসায়ী রমজানের ঈদে প্রায় সারা বছরের কামাই সেরে ফেলেন, কেউ ছয় মাসের কিংবা কেউ তিন মাসের। অন্য কথায় পত্রিকান্তরে প্রকাশ, নরসিংদী জেলার মাধবদীর বুটিক কারখানার ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ বিক্রি হয় রমজান মাসে। আবার শাড়ি, থ্রিপিসের ১৭ হাজার কোটি টাকার বাজার সারা বছর চললেও ঈদের দুই মাস আগে ৭০ শতাংশ বিক্রি শেষ হয়। বাংলাদেশে ২৫ লাখ ছোট-বড় দোকান আছে এবং প্রতিদিন এসব দোকান বিক্রি করে তিন হাজার কোটি টাকার মালামাল। অথচ ঈদের মৌসুমে বিক্রি বৃদ্ধি পায় প্রায় তিন গুণ, অর্থাৎ ৯ হাজার কোটি টাকা। মোটকথা বেতন, উৎসবভাতা, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ইত্যাদি সব সুপার মলের মোহনায় মিলিত হয়ে অর্থনীতির চাকা ঘোরায়। এই ব্যয়ের গুণক এবং লিংকেজ প্রভাব এত শক্তিশালী যে অর্থনীতি ‘ঝিমিয়ে পড়া ভালুক থেকে একটা ষাঁড়ের’ রূপ ধারণ করে। এ-ও মনে রাখা দরকার যে করোনার কারণে বিগত কয়েকটি ঈদ মনের মতো করে উপভোগ করা যায়নি। এবার তাই আনন্দের সীমা নেই। এই সময় ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিলে আন্ত ব্যাংক লেনদেনের সুদের হার চূড়ায় উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য ক্ষুধা নিবারণে ব্যাংক রেট বাড়িয়ে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। প্রসঙ্গত পশ্চিম বাংলায় দুর্গাপূজা একটা বিরাট উৎসব, যেখানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।

উৎসব ঘিরে কর্মকাণ্ডগুলো মূলত ভোগতাড়িত কর্মকাণ্ড। সময়ের বিবর্তনে এই ভোগ ব্যয়ে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। একসময় শুধু খাবারদাবার আর বস্ত্র-পাদুকা প্রাধান্য পেত; হাল আমলে ইলেকট্রনিকস, ফ্যাশন দ্রব্য, ভ্রমণ, প্রসাধনী তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

আমার পক্ষ থেকে কালের কণ্ঠ’র অগুনতি পাঠকের জন্য রইল ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। উৎসবের জোয়ারে ভাসুক অর্থনীতির ভেলা, মিলনমেলা।

লেখক : অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস – সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - রাজনীতি