1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

যে ভাষণে বাঙালি অভিষিক্ত সাহসী বিশেষণে

ফনিন্দ্র সরকার : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২

ফনিন্দ্র সরকার

একথা ঠিক, কোনো বিপ্লব তা ধর্মীয়, সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন সংগঠিত হয় তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষাপটে এক বা একাধিক শক্তিশালী নেতার নেতৃত্বে। ইতিহাস অধ্যয়নে এসব লক্ষ্য করা যায়। তাহলে আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? এটা ভাববার কথা! তিনি এসেছিলেন একটা জাতির শাশ্বত অধিকারের দ্বার উদ্ঘাটন করতে। যে বিষয়টি আমাদের জাতীয় কল্যাণের পক্ষে অপরিহার্য ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আত্মমর্যাদার দিক। আত্মমর্যাদার ভিত্তি মজবুত না হলে সেবার ভাব জাগ্রত হয় না, আত্মমর্যাদা না থাকলে সেবার ভাব অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত হয় না।

বঙ্গবন্ধু সেটিই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তাদের অধীন জনসাধারণকে শোষণ করছে। তিনি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিলেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী একটা জাতি শোষিত হয়ে আসছে, তাদের শোষণের নাগপাশ থেকে উদ্ধার করতে হবে। একটা জাতির ব্যক্তি জীবন কী সামষ্টিক জীবনে চরম দৈন্যদশা চলছিল। কয়েক শতাব্দীর রাজনৈতিক পরাধীনতা মুখ বুঝে সহ্য করেছে নিরীহ বাঙালি। সব রকমের সামাজিক অবমাননা, যা এ অঞ্চলের বাঙালি ধনী বা নির্ধন উভয় শ্রেণির মানুষের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে বঙ্গবন্ধুর চোখ খুলে গিয়েছিল। পাশাপাশি তিনি চোখ খুলে দিয়েছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনের বিরুদ্ধে তিনিই রুখে দাঁড়ান। জাগিয়ে তোলেন সমগ্র জাতিকে। যে দুর্বলতা বাঙালিকে গ্রাস করেছিল এবং যেসব সমস্যায় তদানিন্তন রাষ্ট্র বিপর্যস্ত সে সবের উৎস সন্ধান করে তিনি ডাক দিয়েছিলেন প্রথাগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের। বঙ্গবন্ধুর সাহসী সংগ্রামী ডাকের আগে বাঙালি মানুষ হিসেবে নিজেদের মর্যাদা ও মূল্যকে তেমনভাবে অনুভব করতে পারেনি।

জাতীয় জীবনকে উন্নত করার উপায় সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অধিকতর সচেতন। তিনি বুঝেছিলেন, বিচিত্র উপাদানে গঠিত বাঙালি সমাজের পেছনে রয়েছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস; সেই সমাজকে আধুনিক ও মহান জাতিতে রূপান্তর করা সহজ কাজ নয়। তার জন্য প্রয়োজন নতুন ধরনের চেতনা। যে চেতনার মধ্য দিয়ে গভীর আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান এবং প্রচ- ইচ্ছাশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। উচ্চভাব ও উচ্চাদর্শকে কাজে পরিণত করতে চাই মনুষত্বের সংগ্রাম। তিনি সেই সংগ্রামকেই এগিয়ে নিতে নেতৃত্বে আসীন হয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির পর যে পাকিস্তানের জন্ম হয়, সেই পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান বাঙালি অধ্যুষিত একটি উর্বর ভূমির মানচিত্র। নীরিহ শান্তিপ্রিয় অতিথিপরায়ণ ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় দুঃশাসনের স্ট্রিমরোলার। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী জাতিকে সাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রলুব্ধ করতে পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। হিন্দু-মুসলিম ভেদনীতিকে প্রভাবিত করে। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান এ ভেদনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ধীরে ধীরে সংগ্রাম গড়ে তোলে গোটা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। প্রাগৈতিহাসের ধারাবাহিকতায় তিনি পাকিস্তানি ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থায় ঐক্যবদ্ধ শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বাঙালিকে এক মোহনায় দাঁড় করাতে সক্ষম হন। তদানিন্তন পাকিস্তানের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হন তার যোগ্যতর ভূমিকার কারণে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পথরেখায় স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৪৯ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধু আন্দোলন-সংগ্রাম করে জেল খাটতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হলে জেলখানা হয়ে ওঠে দ্বিতীয় আবাসস্থল।

১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ৬ দফার ভিত্তিতে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। বঙ্গবন্ধুকে জেলে যেতে হয়। এর কিছুদিন পর মুক্তি পেলে তিনি সারা বাংলাদেশে ৬ দফার আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন। জনগণ তার ডাকে সাড়া দেয়। ১৯৬৮ সালে ১৭ জানুয়ারি ঢাকার কারাগার থেকে বন্দি করে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়, বাঙলার মানুষ জানতে পারে না। ছাত্র-জনতার সেøাগান জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনব, বাঙালির চাপের মুখে ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জান্তা শাসক শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় শেখ মুজিব যুদ্ধ নয়, শান্তির সেøাগান সামনে নিয়ে আসেন। যুদ্ধের আগে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে হিন্দু­-মুসলিম দাঙা সংঘটিত হয়। মূলত সে দাঙা ছিল একতরফা। সেটি ছিল তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ। শেখ মুজিব সেই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি তার ঢাকার বাসভবনে অনেক হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দেন। দাঙাকবলিত এলাকায় শেখ মুজিব ছুটে যান। বস্তুত পাকিস্তানি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যেই দাঙা বাঁধানো। মুজিব সেটি বুঝতে পারেন। ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুবের পতন ঘটলেও নরপিশাচ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির ওপর নির্যাতন অব্যাহত রাখে। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। নানা অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় পাকিস্তানি জান্তা শাসক। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। উত্তাল হয়ে ওঠে মার্চ মাস। আন্দোলন-সংগ্রামে মুখরিত দেশ। ১ মার্চ ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। ৩ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে হরতালের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে হরতালে।

তারপর আসে ৭ মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ উপস্থাপন করেন। সাহস ও মানবিক আবেদন সংবলিত অমর বাণী হয়ে ওঠে স্বাধীনতার মহাকাব্য। ১৭ মিনিটের সেই ভাষণে বাঙালি জাতি হয়ে ওঠে অসীম সাহসী। রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে কোনো কার্পণ্য করেনি। বাঙালি অভিসিক্ত হয় যশের আসনে। ভাষণে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ অধিকার আদায়ের জন্য যুদ্ধ করার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে বাঙালি জাতিকে উঠে দাঁড়াতে আহ্বান করেন। বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করÑ এ সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। সে এক স্মৃতিমধুর উদ্দীপনা। সব ভয় উপেক্ষা করে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এক চিরন্তন আবেদন সৃষ্টি হয়। বাঙালি মানবসত্তার বীরসুলভ চিত্তবৃত্তিকে প্রসারিত করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। ৯ মাসের যুদ্ধে সে প্রমাণ এ জাতি দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণ চালায়। সে কালরাতেই বঙ্গবন্ধু ১২.৩০ মিনিটে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সে ঘোষণা চটগ্রামে পৌঁছে গেলে ২৬ মার্চ সারা দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা পৌঁছে যায়। সেই থেকেই ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। যুদ্ধের পরিণতি লাভ করে বাঙালির বিজয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে বিশ্বের মানচিত্রে। যদিও ২৬ মার্চ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়; কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করতে হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক শ্রেষ্ঠ ও সাহসী ভাষণের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ ভাষণ একটা জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অমিয় দলিল। মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণাদায়ক মহান বাণী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অমর অধ্যায় ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। আমরা আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকি সেই বীরদের, যারা পাকিস্তানি আক্রমণকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের জীবন আহুতি দিয়েছেন সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে। এ পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির অন্তরাত্মাকে মহৎ উদ্দেশ্যে তেজদীপ্ত করে রাখবে।

লেখক:ফনিন্দ্র সরকার- কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
ইমেইল: phani.sarker@gmail.com


সর্বশেষ - রাজনীতি