1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাঙালির সংগ্রামে বাংলা গান

শাহরিয়ার কবির : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

বাঙালির জীবনে গান আবহমান কাল ধরে আনন্দ-বেদনা ও প্রেম-বিরহের পাশাপাশি প্রতিবাদ ও দ্রোহের এক অনুপম অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। বাংলার শ্রমজীবী মানুষ আজও গানের ভেতর খুঁজে পায় কর্মের প্রেরণা। জমিদার, রাজা, মহারাজা, নবাব ও বাদশাহরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন শাস্ত্রীয় সংগীতের, সাধারণ মানুষ চর্চা করেছে অন্য গানের, অঞ্চল ও পেশাভেদে একেক জায়গায় তার একেক রকম নাম।

আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলাদেশে অনেক কৃষক আন্দোলন হয়েছিল। কখনো তা ছিল জমিদার ও মহাজনের বিরুদ্ধে, কখনো ছিল বেনিয়া ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। সেই সময় আন্দোলনরত কৃষকরা তাঁদের গানে অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁরা গানের ভেতর দিয়ে বন্দনা করেছেন আন্দোলন ও সংগ্রামের নায়কদের এবং এভাবে গান পরিণত হয়েছে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদানে।

এসব গান চারণকবি ও গায়কদের কণ্ঠে এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে ছড়িয়ে পড়লেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রচয়িতারা নাম গোপন রেখেছেন। কখনো বা রচয়িতার নাম অজ্ঞাত থেকেছে অনবধানতার কারণে। সেই সময় যে কেউ ইচ্ছা করলেই গান বা কবিতা ছেপে প্রকাশ করতে পারতেন না। দু-একটি ক্ষেত্রে নাম জানা যায় রচয়িতা মধ্যযুগের গীতিকবিদের মতো গানের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করেছিলেন বলে। সুপ্রকাশ রায়ের ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ গ্রন্থে এ ধরনের গানের কিছু বিবরণ রয়েছে।

উনিশ শতকের কয়েকজন লেখক তাঁদের দেশপ্রেমমূলক নাটক ও উপন্যাসে কিছু গান অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যার ভেতর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছে। সুকুমার মিত্র তাঁর ‘১৮৫৭ ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিফলন উনিশ শতকের গানে কিভাবে ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত শ্রী উপেন্দ্রচন্দ্র মিত্রের লেখা ‘নানাসাহেব’ উপন্যাসের একটি গানে বলা হচ্ছে—‘শুন সবে এক মনে ভারত সন্তান/দাও প্রাণ চাও যদি ভারতের মান।’ তখনকার উপন্যাস ও নাটকে গান গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো।

কলের গান আবিষ্কারের আগে এসব গান গীত হতো শিষ্য বা বংশপরম্পরায়। গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রচলন হয়েছে বিশ শতকের শুরুতে। যে কারণে বাংলা স্বদেশি গান বা দেশাত্মবোধক গানের সূচনা অনেকের মতে ১৯০৫ সাল থেকে, যখন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ ঠাকুরবাড়ির অনেকে গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন এবং গেয়েছেনও। তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘চলরে চল সবে ভারত সন্তান’, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘মিলে সবে ভারত সন্তান’ আর রবীন্দ্রনাথের গদ্য, কবিতা ও গান ছিল সংখ্যায় প্রচুর। আমাদের জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ তিনি লিখেছেন বঙ্গভঙ্গের বছরেই। ১৯০৫ সালে লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য স্বদেশি গানের ভেতর রয়েছে ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, ‘সার্থক জনম আমার’, ‘যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না’, ‘ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে’, ‘বাজে  তোমার বাজে বাঁশি’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ প্রভৃতি।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংযোজন করেছিল এক নতুন মাত্রা। এর আগে উনিশ শতকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্ম। তখনকার অনেক সাময়িকপত্রে কিংবা গ্রন্থে লেখকরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু ধর্মকে সমার্থক বিবেচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথই প্রথম সচেতনভাবে বাঙালির ধর্মীয় সত্তার চেয়ে ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুখ্য উপাদান হিসেবে গণ্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কবিদের ভেতর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং মুকুন্দ দাস স্বদেশি গানের জোয়ার বইয়ে দিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অবিস্মরণীয় গান ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’, অতুলপ্রসাদের ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’, রজনীকান্তের ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’, মুকুন্দ দাসের ‘ভয় কি মরণে থাকিতে সন্তানে’ প্রভৃতি গানের ভেতর মূর্ত হয়েছে এই শতকের প্রথম তিন দশকের দেশপ্রেমের চেতনা।

কাজী নজরুল ইসলাম দেশাত্মবোধক গানে যুক্ত করলেন আরেক মাত্রা। ‘কারার ঐ লোহ কপাট’, ‘এই শিকল পরা ছল মোদের’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’, ‘চল চল চল’, ‘জাগো অনশন বন্দী’ প্রভৃতি গানে সেই সময়ের সংগ্রামী চেতনার পাশাপাশি মানবাধিকারের অঙ্গীকার প্রথমবারের মতো সংযোজিত হয়েছে। নজরুল, ডি এল রায় ও রবীন্দ্রনাথের সেই সময়কার দেশাত্মবোধক গান কালের গণ্ডি অতিক্রম করে সমান আবেদন নিয়ে আজও আমাদের উদ্বেলিত করে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব গান রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।

২৫ বছর আগে ‘মুক্তিযুদ্ধের গান’ নামের দীর্ঘ প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের সময় বিষয়টি আমি তিন পর্বে ভাগ করেছিলাম। প্রথম পর্ব—ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল, দ্বিতীয় পর্ব পাকিস্তানের প্রায় ঔপনিবেশিক শাসনকাল এবং তৃতীয় পর্ব মুক্তির কাল (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ)। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে বিকাশ ঘটেছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কারণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল তারই যৌক্তিক পরিণতি। এর প্রতীকী প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচনের মাধ্যমে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রবীন্দ্রসংগীতপ্রীতি অজানা কোনো বিষয় নয়। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজনৈতিক সম্মেলনের উদ্বোধনে তিনি সংগীতকে প্রেরণার অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতেন। সংগীতগুরু সন্জীদা খাতুন জানিয়েছেন, ১৯৫৬ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আইনসভার সদস্যরা ঢাকার কার্জন হলে মিলিত হয়েছিলেন এক সম্মেলনে। এই আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ মুজিব। আয়োজকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সন্জীদা খাতুন সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করবেন। যথাসময়ে তিনি যখন গান গাইবার জন্য তৈরি হয়ে মঞ্চে উঠবেন তখন দলের এক তরুণ কর্মী তাঁকে এসে বললেন, শেখ মুজিব আপনাকে অনুরোধ করেছেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের জানিয়ে দিতে চান বাংলার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কত গভীর। সন্জীদা আপা অন্য গানের কথা ভেবেছিলেন। তিনি বললেন, ‘সোনার বাংলা’ তো অনেক বড় গান। পুরোটা আমার মনেও নেই। তখন সেই তরুণ কোত্থেকে একটা গীতবিতান এনে তাঁকে দিলেন। মঞ্চে উঠে গীতবিতান দেখে সন্জীদা আপা ‘আমার সোনার বাংলা…’ পুরো গানটা গেয়েছিলেন। (লেখকের সঙ্গে কথোপকথন, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তখন আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় ১০০ বছর ধরে বাংলার লেখক, গায়ক, সাংবাদিক, কবি, শিল্পী ও রাজনীতিবিদরা কিভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত নির্মাণ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি তিনি যে পদ্ধতিতে গ্রহণ করেছিলেন এবং যেভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে, সেই সব ঘটনা পর্যালোচনা করলে মাস্টারদা ও নেতাজির চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের প্রচুর সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হবে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক প্রেরণার উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বঙ্গভঙ্গের কালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু ষাটের দশকের শুরুতে গ্রহণ করেছিলেন, একাত্তরে তার যৌক্তিক পরিণতি আমরা দেখেছি। সমগ্র পর্বটি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন একই লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে—কখনো গণতান্ত্রিক অধিকার, কখনো স্বায়ত্তশাসন, কখনো স্বাধীনতা।

তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ ‘মুক্তির গান’ নামে যে ছবিটি বানিয়েছেন সেটি প্রধানত মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিন কর্তৃক ধারণকৃত ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র একটি অংশের কার্যক্রমের ওপর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গানের কী ভূমিকা ছিল, শিল্পীরা কিভাবে গান গেয়ে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন তার একমাত্র দৃশ্যগ্রাহ্য প্রামাণ্য দলিল এটি। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পীদের ভ্রাম্যমাণ দলগুলো ছাড়াও তাঁদের প্রধান কার্যক্রম ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ঘিরে। এখান থেকেই রচিত, সুরারোপিত ও গীত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ক গানগুলো। ‘মুক্তিযুদ্ধের গান’ ছবিতে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত বিভাগের পরিচালক সমর দাস বলেছেন, ‘শিল্পীদের তখন এতটুকু বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ ছিল না। যাঁরা কখনো গান লেখেননি তাঁরাও গান লিখেছেন।’ সমর দাস এবং তাঁর সহযোদ্ধারা সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন।

শুধু বাংলাদেশের শিল্পীরাই নন, কলকাতার বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীরাও এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর গান গাইবার জন্য। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা, অংশুমান রায়ের কণ্ঠে তাঁরই দেওয়া সুরে গাওয়া ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ পৌঁছায়নি বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল খুঁজে পাওয়া যাবে না। অংশুমান রায় ছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, শ্যামল মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রুমা গুহঠাকুরতা, আরতি মুখোপাধ্যায় ও দেবব্রত বিশ্বাসের মতো বরেণ্য শিল্পীরা।

চল্লিশের দশকে আইপিটিএর মাধ্যমে বাংলা গানে যে বিপ্লবী চেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল আলোচ্য প্রামাণ্যচিত্রে সে বিষয়ে কলিম শরাফী ছাড়াও বলেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তিনি ছিলেন আইপিটিএর অন্যতম প্রধান কম্পোজার ও গায়ক, যিনি মারা গেছেন ১৯৮৭ সালে। আইপিটিএর গান সম্পর্কে আমি তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম ১৯৭৯ সালে কলকাতায়। তিনি প্রধানত বাংলাদেশের লোকসংগীতের ফর্মটি তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন। সুরগুলো প্রচলিত জারি, সারি, ভাটিয়ালি থেকে নেওয়া। উদাহরণ দিয়ে চমৎকারভাবে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন তিনি। যেমন তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ওপর হেমাঙ্গ বিশ্বাস গান লিখেছিলেন, ‘ঘোর কলিকাল আইল আকাল সোনার বাংলায়।’ তিনি এই গানের সুর নিয়েছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের বাউল গায়ক শরতের একটি গান থেকে, যার কথা ছিল ‘আইল রে চৈতন্যের গাড়ি সোনার নদীয়ায়।’

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আরেকটি বিখ্যাত গান ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণ ভাইরে’। এর সুর তিনি নিয়েছেন সিলেট অঞ্চলের নৌকার মাঝিদের সারি গান, ‘সাবধানে গুরুজীর নাম লইওরে, সাধু ভাই’ থেকে। তাঁর বিখ্যাত মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য প্যারডি গানটির সুর তিনি নিয়েছিলেন তাঁদের এলাকার এক অত্যাচারী জমিদার মারা যাওয়ার পর গ্রামের গায়কদের বাঁধা একটি গান থেকে। তিনি বলেছেন, ‘ফর্মটা প্রচলিত রেখে কনটেন্টটা শুধু বদলে দিয়েছি।’

আইপিটিএর আরেক দিকপাল ছিলেন সলিল চৌধুরী। তাঁর চল্লিশের দশকের গান ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ ষাটের দশকের আন্দোলনে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সমান জনপ্রিয় ছিল।

‘মুক্তিযুদ্ধের গান’ ছবিতে এর আগে সংগৃহীত গানের চেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সংগ্রহ করা হয়নি। বিশেষ করে স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বের গান। বেশির ভাগ গানের রচয়িতা, সুরকার ও শিল্পী আজ বেঁচে নেই। অনেকেই বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছেন। কলিম শরাফী, আবদুল লতিফ, সমর দাস, গাজীউল হক, কামাল লোহানী, সন্জীদা খাতুন, আবুবকর সিদ্দিক ও অজিত রায়ের আলোচনায় সেই নামগুলো আবার ভেসে উঠেছে স্মৃতির পর্দায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা বলেছেন তাঁদের শরণার্থী জীবনের কথা, সহশিল্পীদের কথা, কলকাতার বন্ধুদের কথা।

‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শতাধিক শিল্পী। ১৪৪ লেনিন সরণি ছিল তাঁদের কেন্দ্র। তাঁদের বিভিন্ন জায়গা থেকে লেনিন সরণির এই বাড়িতে এনে জড়ো করেছিলেন কথাশিল্পী দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁকে বলা হতো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর বাংলার সবচেয়ে শক্তিমান লেখক। সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হককে সঙ্গে নিয়ে দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে এমনকি শরণার্থী শিবির থেকেও শিল্পীদের খুঁজে এনে গঠন করেছিলেন এই সাংস্কৃতিক স্কোয়াড। তাঁদের জন্য মাসোহারার ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। তাঁরই নির্দেশে ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র জন্য আমি ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলাম, যেটি স্বাধীন বাংলা বেতারসহ কলকাতা ও দিল্লিতে বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। কলকাতায় এর প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। কলকাতার মানুষ সেদিন মঞ্চে প্রথম শুনলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গান। ‘রূপান্তরের গান’ কলকাতা ও দিল্লির দর্শকদের কিভাবে অভিভূত করেছে, কিভাবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে স্পর্শ করেছে—তার বয়ান পাওয়া যাবে এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত ‘আমাদের একাত্তর’ গ্রন্থে, যেখানে একাত্তরের প্রচারযুদ্ধের সংশপ্তকরা বর্ণনা করেছেন তাঁদের যুদ্ধযাত্রা ও যুদ্ধজয়ের অভিজ্ঞতা।

লেখক : শাহরিয়ার কবির – সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।


সর্বশেষ - রাজনীতি