1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

আদর্শের দ্যুতি ছড়াচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘গুঞ্জন’ পাঠাগার

নিজস্ব প্রতিবেদক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

২০০৪ সালের ৩০ মার্চ। মাত্র তিনটি বই নিয়ে ছোট্ট একচালা টিনের ঘরে যাত্রা শুরু হয় গুঞ্জন পাঠাগারের। উদ্যোক্তা স্বপন মিয়া তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি প্রেম তার। আর সেই প্রেম থেকেই পাঠাগার গড়ে তোলার ইচ্ছা। আলো ও আদর্শের গুনগুন শব্দ সমাজে ছড়িয়ে দিতেই নামকরণ করা হয় গুঞ্জন পাঠাগার। স্বপনের আবেগ আর ভালোবাসায় গড়া গুঞ্জন পাঠাগার কৈশোর পেরিয়ে এখন যৌবনে।

সাড়ে ১৮ বছর বয়সী পাঠাগারটি এখন প্রায় ১০ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ এক পাঠশালা। যেখানে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি খ্যাতনামা লেখকদের বই এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থও পড়তে পারেন। গুঞ্জন পাঠাগার এখন শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয়দের কাছে। পাঠাগারের বই দিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা। লেখাপড়া শেষ করে অনেকই ভালো চাকরিও করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুঞ্জন পাঠাগারের উদ্যোক্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার সুহাতা গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে স্বপন মিয়া (৩১) এখন জেলার কসবা উপজেলার বেসরকারি একটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক। তবে তার জীবনসংগ্রামের গল্পটা কষ্টে ভরা। মাত্র দেড় বছর বয়সেই বাবাকে হারান স্বপন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন মা রাজিয়া খাতুন। মাটি কাটার কাজ করে সন্তানদের বহু কষ্টে লালন-পালন করেছেন তিনি। স্বপনের দুই ভাই রিকশাচালক।

গ্রামের একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই পাঠাগার গড়ার চিন্তা আসে স্বপনের মাথায়। তবে অর্থের অভাবে যেখানে দুইবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছিল, সেখানে স্বপনের পাঠাগার করার ইচ্ছাকে খেয়ালিপনাই মনে করেছিলেন পরিবারের সবাই।

তবে ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি করতেন স্বপন। বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি। তার ভাবনায় ছিল লেখালেখির জন্য প্রচুর বই পড়তে হবে। কারণ বই জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। তাছাড়া গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার চিন্তাও ছিল স্বপনের। সেজন্য অনেকটা পরিবারের অমতেই বাড়ির জায়গায় এনজিও থেকে ৮ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছোট্ট একচালা টিনের ঘর বানিয়ে শুরু করেন গুঞ্জন পাঠাগারের যাত্রা।

পাঠাগারের জন্য বিভক্ত হয়ে পড়ে স্বপনের পরিবার। দুই ভাই র্শত দেন, পরিবারে থাকতে হলে পাঠাগার ছাড়তে হবে। তবে বইপোকা স্বপন পরিবার ছেড়ে পাঠাগারকে আঁকড়ে ধরেন। পরবর্তীতে স্বপনের মা-ও তাকে সঙ্গ দেন। সংসার, পাঠাগার আর নিজের পড়াশোনা চালাতে দিনমজুরি করেন স্বপন। জীবিকার তাগিদে পথেঘাটে পান, সিগারেটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেছেন তিনি। সামান্য আয়ে যেখানে নুন আনতেই পান্তা ফুরায়, সেখানেও পাঠাগার বন্ধ হতে দেননি। একাই পাঠাগারের সব খরচ জুগিয়েছেন।

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন স্বপন মিয়া। মায়ের মৃত্যুর পর এখন গুঞ্জন পাঠাগারই তার সবকিছু।

মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সোয়া ২ শতাংশ জায়গা পাঠাগারের নামে দান করে সেখানে ঋণের টাকায় একতলাবিশিষ্ট পাকা ভবন করেছেন। পাঠাগারেই মাদুর পেতে মাটিতে ঘুমান স্বপন। কলেজ থেকে যে টাকা বেতন পান, তার বেশিরভাগই ব্যয় করেন পাঠাগারের কাজে।

দীর্ঘ সাড়ে ১৮ বছর ধরে সুহাতা গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে স্বপনের গুঞ্জন পাঠাগার। বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের পাড়াশোনা টিকিয়ে রাখতে পাঠাগারটি একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকজন ছাত্র পাঠাগারে থেকেই পড়াশোনা করে। এছাড়া প্রতি শুক্রবার পাঠচক্র বসে গুঞ্জন পাঠাগারে। সেখানে শিশু-কিশোরদের জন্য আয়োজন করা হয় সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই নিয়মিত আসেন গুঞ্জন পাঠাগারে, জ্ঞান আহরণে।

নবীনগর উপজেলার সুহাতা গ্রামের রমজান খান জানান, তার পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হওয়ায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থার তার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে তখন বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে স্বপন তাকে গুঞ্জন পাঠাগারে নিয়ে আসেন। এখন এই পাঠাগারে থেকেই নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনার্স শেষ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে মাস্টার্স করছেন বলে জানান রমজান।

নবীনগর উপজেলার ভোলাচং উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাওহীদ জাহান চৌধুরী জানায়, নিয়মিত গুঞ্জন পাঠাগারে এসে বই পড়ে সে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সব ধরনের বই আছে এখানে। এছাড়া তার আরও কয়েকজন সহপাঠী পাঠাগারে এসে বই পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আনিসুল হকের বই পড়তে বেশি ভালো লাগে বলে জানায় সে।

নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর আব্দুল জব্বার স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক রোকসানা জেবিন মলি বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় শিশু-কিশোরদের কথা চিন্তা করে এমন পাঠাগার করায় শিশু বয়স থেকেই বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। পাঠাগারের মনোরম পরিবেশ যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। এই পাঠাগারটি অনেকটা নীরবে-নিভৃতে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার মাঝে।

গুঞ্জন পঠাগারে নিয়মিত আসা আরেক পাঠক ও কসবা উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা তুহিন কান্তি দাস বলেন, নবীনগর তথা পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জন্য আলোর দিশারি হয়ে দাঁড়িয়েছে গুঞ্জন পাঠাগার। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও বঞ্চিত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতে কাজ করছে পাঠাগারটি। মূলত এই পাঠাগারটি প্রত্যন্ত এলাকায় অনেকটা সূর্যের আলোর মতো জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একচালা টিনের ঘর থেকে গুঞ্জন পাঠাগারের এখনকার পাকা ভবন তৈরির জন্য উপজেলা ও জেলা প্রশাসন এবং অনেক ব্যক্তি সহযোগিতা করেছেন জানিয়ে স্বপন মিয়া বলেন, সমাজে আমার মতো অনেকেই আছে যারা বই কিনে পড়তে পারে না। শুধুমাত্র টাকার অভাবে অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের কথা চিন্তা করেই গুঞ্জন পাঠাগার করা হয়েছে। এই পাঠাগারের জন্য আমাকে পরিবার থেকে আলাদা হতে হয়েছিল। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আমি রাস্তায় পান-সিগারেট বিক্রি করেছি। তবুও পাঠাগারটি বন্ধ হতে দিইনি।

তিনি আরও বলেন, আমি একটা মানুষ না থাকলে কিছু হবে না। কিন্তু এই পাঠাগারটি না থাকলে এলাকার অনেক ক্ষতি হবে। তাই আমার পুরো জায়গাটি পাঠাগারে দিয়ে দিয়েছি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই পাঠাগারে বই পড়ে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। অনেকে ভালো চাকরি পেয়েছে। দুইজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। সুহাতা গ্রাম আলোকিত হয়েছে গুঞ্জন পাঠাগারের আলোতে। আমি চাই জ্ঞানের এই আলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।

এ বিষয়ে নবীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পাঠাগারের জন্য স্বপন তার নিজের ব্যক্তি জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। তার এই ত্যাগের কারণে এলাকার দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারছে। গুঞ্জন পাঠাগার শুধু জ্ঞানের আলোই ছড়াচ্ছে না, ছেলেমেয়েদের মাদক থেকেও দূরে রাখতে সহায়তা করছে। বই পড়ার কারণে মেধার বিকাশ হচ্ছে, জ্ঞানের পরিধি বাড়ছে।


সর্বশেষ - রাজনীতি