গত ১৫ বছরে বদলে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক সব সূচক, যেখানে দারিদ্র্য বৈষম্য বিশেষ আলোচনার স্থান করে নিয়েছে। দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অতি দারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নেমে এসেছে সত্যি, কিন্তু ধনী গরিবের বৈষম্য এমন মাত্রায় বেড়ে গেছে (গিনি সহগ ০.৪৯), যা বিশ্বের প্রথম স্থান করে নিয়েছে।
ইতিমধ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, যাদের স্লোগান হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ :উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ যথা ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ গড়ার কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যেমন—মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভরতা, কৃষিব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ, সর্বজনীন পেনশন, দারিদ্র্য বিমোচন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ইত্যাদি। কিন্তু আয়বৈষম্য যে বেড়ে গেল, গ্রামের মানুষ কষ্টে আছে—তার সুরাহা কীভাবে হবে, তার আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ আমাদের মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৭৯৩ ডলার, বাজেটের আকার ৬১ হাজার কোটি থেকে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি, জিডিপির আকার বেড়েছে ১২ গুণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বেড়েছে ১৩ গুণ, রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ গুণ। তার পরও কেন সমাজে কেন এত অসংগতি, তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য, সেই সঙ্গে গ্রামে বেড়েছে মানুষের খরচ, পাশাপাশি বেড়ে গেছে পরিবারভিত্তিক ঋণগ্রহণও। এছাড়া ঋণ করে সংসার চালায় দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ। একটি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ এবং মাথাপিছু ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলোর ঋণ ২১০ শতাংশ বেশি। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাও বেশি। পাশাপাশি ভাত খাওয়া কমেছে, বেড়েছে অন্যান্য খাদ্যগ্রহণ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। এর মধ্যে পল্লি অঞ্চলে ২০ দশমিক ৫ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে।
অন্যদিকে বেড়েছে ভোগবৈষম্যও। ২০২২ সালের হিসাবে ভোগব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান শূন্য ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪। তবে ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৩২১। এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ। আবার সর্বনিম্নে থাকা ৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় মোট আয়ের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখানে স্পষ্ট হয়েছে যে, ধনীদের আয় বাড়ছে উচ্চহারে আর গরিবদের বাড়ছে ধীরে। এ দুই অংশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজ করছে (বিবিএস)। প্রতিবেদনের তথ্য থেকে আরো দেখা যাচ্ছে, দেশের সর্বাধিক দারিদ্র্যপীড়িত বিভাগ এখন বরিশাল, যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ; অর্থাত্ ছয় বছরের ব্যবধানে সেখানে এই হার দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে সিলেট বিভাগেও।
উল্লিখিত তথ্য প্রমাণ করে, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমলেও কোনো কোনো অঞ্চলে বা গ্রামের একটি বড় অংশে ছয় বছরে তা আরো বেড়ে গেছে। ছয় বছরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কোনো কোনো অংশে দারিদ্র্য না কমে কেন বেড়ে গেল, এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। একটি বড় কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক বৈরীতায় দেশের অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো বৃহত্তর গ্রামীণ মানুষের স্বার্থের প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি ও মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই ব্যর্থতার জেরে দারিদ্র্যের হাত ধরে সেখানে বেড়েছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ও আয়বৈষম্যও। গত ৩১ ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর তথ্য জানাচ্ছে, গড়ে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন খাদ্যোত্পাদনকারী কৃষক। আর তাদের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশ, যা এ সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বেশি খুলনা জেলায়। সেখানে দারিদ্র্যের হার বেশি হারে বাড়ার কথা। কিন্তু পাশের বিভাগে দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি। দারিদ্র্য কমানোর প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বেশি জরুরি। কারণ, হঠাত্ যে কোনো ধরনের আঘাতে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন। তাদের সুরক্ষা দিতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হবে।
বস্তুত রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোয় গ্রামের প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে, সেটি থেকেই কৃষকের মধ্যে বর্ধিত হারের এ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, বৈষম্যের মাত্রা কতটা বেড়েছে, এর তথ্যও রয়েছে আয় ও খানা জরিপ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ এখন দখল করে আছে সমগ্র জাতীয় আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় নীতি, পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে সৃষ্ট এই যে বৈষম্য, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেটিকে ক্রমান্বয়ে আরো বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলেছে এবং এরই প্রতিফলন ঘটেছে রাষ্ট্রীয়প্রতিষ্ঠান বিবিএসের জরিপে। বৈষম্য বৃদ্ধির সুবাদে সর্বাধিক মাত্রায় ও হারে এবং সবচেয়ে আগে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রামের মানুষ, যারা এখন পর্যন্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ মানুষ যদি এরূপ ক্রমবর্ধমান হারে দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে থাকে, তাহলে প্রকারান্তরে তা দেশের মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেলে দেবে। আর যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশে বিরাজমান রয়েছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এই ভোগান্তির মাত্রা নিকট ভবিষ্যতে আরো বেড়ে যাবে।
২০০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা ২০২০-এর ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু মোটামুটি বেশ ভালোভাবেই টিকে গিয়েছিল, যার পেছনে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা ছিল কৃষির। তাই আগামী দিনের দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্যনিরাপত্তায় কৃষি ও কৃষককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে—এই হোক নতুন বছরে নতুন সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশা।
লেখক : ড. মিহির কুমার রায় – গবেষক ও অর্থনীতিবিদ। ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা