আইন অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের ফলের গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। গত ৯ জানুয়ারি গেজেট হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের। এই হিসাবে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) আগামী ৭ এপ্রিলের মধ্যে সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের ভোট করতে হবে। ভোটার তালিকা প্রস্তুতসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে ইসিকে ২০ ফেব্রুয়ারির পরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।
জানা গেছে, আগামী মার্চের মধ্যে ভোট করার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। অবশ্য সংসদ সদস্যদের ভোটে অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনে ভোটগ্রহণের নজির এখন পর্যন্ত নেই। সংসদের আসনের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত সংরক্ষিত মহিলা আসনে রাজনৈতিক দল বা জোটগুলো তাদের নির্ধারিত আসনের জন্য একক প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের মতো সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার প্রয়োজন পড়লেও ভোটার ও আসন বণ্টনসহ কমিশনকে এই নির্বাচনের নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইনে বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এই আইন অনুযায়ী, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা শপথ গ্রহণ করেছেন, তাদের তথ্য তিন কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে নির্বাচন কমিশনে পাঠাবে। সংসদ সচিবালয় থেকে ইতোমধ্যে শপথ নেওয়া ২৯৮ জনের তথ্য নির্বাচন কমিশনে জানিয়ে দিয়েছে বলে সংসদ সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন) নাজমুল হক নিশ্চিত করেছেন।
আইন অনুযায়ী, নির্বাচিতদের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের পরবর্তী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে দল বা জোটগুলো বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তাদের জোটের অবস্থান নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। এদিকে গেজেট হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যদের রাজনৈতিক দল বা জোটওয়ারি সদস্যদের পৃথক তালিকা প্রস্তুত করবে বলে আইনে উল্লেখ রয়েছে। সে অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচনের জন্য আগামী ৭ এপ্রিলের মধ্যে দল বা জোটগুলোকে ইসিতে তাদের অবস্থান জানাতে হবে এবং ইসি আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সদস্যদের তালিকা (ভোটার তালিকা) প্রস্তুত করবে।
তালিকা প্রস্তুতের পরের কার্যদিবসে অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি সেই তালিকা নির্বাচন কমিশনে প্রকাশ্য কোনও স্থানে টানিয়ে দিতে হবে। একইসঙ্গে সংসদ সচিবালয়কে সেই তালিকার প্রত্যায়িত কপি টানিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠাবে। নির্বাচনের আগে সেই তালিকায় আর কোনও পরিবর্তন করা যাবে না। তবে কোনও করণিক ভুল হলে নির্বাচন কমিশন তা সংশোধন করতে পারবে।
আসন বণ্টনে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যদের জন্য কোনও নির্ধারিত নির্বাচনি এলাকা নেই। তারা কেবল দলীয় বা জোটের সদস্য হিসেবে পরিচিত হবেন। এক্ষেত্রে দল বা জোটের প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে মহিলা আসন বণ্টিত হবে।
সংবিধান অনুসারে বর্তমানে সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ৫০টি। এই ৫০ সংখ্যাকে ৩০০ (দেশের নির্বাচনি এলাকা) দিয়ে ভাগ করলে যে ভাগফল পাওয়া যাবে, তাকে কোনও দল বা জোটের যে সংখ্যক সদস্য শপথ নিয়েছেন—তা দিয়ে গুণ করলে যে ফল পাওয়া যাবে, সেই সংখ্যক মহিলা সদস্য হবে ওই দল বা জোটের। গুণফল ভগ্নাংশ হলে সেক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৫ (০.৫) বা তার থেকে বেশি সংখ্যকের জন্য একটি আসন পাওয়া যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে বণ্টিত আসন সংখ্যা মোট আসনের থেকে বেড়ে গেলে ভগ্নাংশের হিসাবে হেরফের হতে পারে। আইনে কোনও কোনও ক্ষেত্রে লটারির বিধানও রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এবার আওয়ামী লীগ সংসদে ২২৩টি আসন পেয়েছে (বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ময়মনসিংহ-৩-সহ)। এই হিসাবে এ দলটির ৩৭টি সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পাওয়ার কথা। ৫০ ভাগ ৩০০=০.১৬৬৭। এরপর ২২৩ গুণ ০.১৬৬৭=৩৭.১৭। এই হিসাবে জাতীয় পার্টির ১১টি আসনের বিপরীতে ২ জন মহিলা সংসদ সদস্য পওয়ার কথা। অপরদিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত ৬২ জন জোটবদ্ধভাবে ১০ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পাবেন। বাকি তিনটি দল (জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি) জোটগতভাবে এলে তারা একটি আসন পাবেন। অবশ্য সংরক্ষিত আসন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে চাইলে যেকোনও দল বা জোট তাদের ইচ্ছামতো যেকোনও দল বা জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পারবে।
এখানে উল্লেখ্য, প্রার্থীর মৃত্যুতে নির্বাচন বাতিল হওয়া নওগাঁ-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হলেও দলটি তাদের অংশে সংরক্ষিত আসনে ৩৭ জন সদস্যই প্রাপ্য হবে।
আইন অনুযায়ী, শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যরাই সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে ভোটার হবেন এবং এই ভোটাররা কেবল নিজেদের দলের প্রাপ্ত আনুপাতিক আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে বণ্টিত আসনে একক প্রার্থী হলে ভোটগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু বণ্টিত আসনের তুলনায় ওই দল বা জোটের প্রার্থী বেশি হলে ভোট নিতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীরাই নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। অবশ্য এমন ভোটের নজির এখনও দেখা যায়নি।
জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন আইন অনুযায়ী, সাধারণ নির্বাচনের মতো সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা করতে হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কোনও কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। নির্বাচন কমিশন জোটের তালিকা প্রকাশ্যে টানানোর পর এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ করবে। একইসঙ্গে মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই ও ভোটের দিন ঘোষণা করবে। এছাড়া ভোট গ্রহণের স্থান নির্ধারণ করবে। ভোটের প্রয়োজন পড়লে সংসদ ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনের জন্য সংসদের কোনও বৈঠকের প্রয়োজন নেই। অধিবেশন চলুক বা না চলুক, কোনও সমস্যা নেই। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংসদ অধিবেশন কক্ষে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও সংরক্ষিত আসনের ভোট অধিবেশন কক্ষের বাইরে সংসদ সচিবালয়ের যেকোনও স্থানে হতে পারে।
এদিকে আইন অনুযায়ী, কোনও দল বা জোট যদি তাদের প্রাপ্য মহিলা সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী না দেয় বা প্রাপ্য আসনের তুলনায় কম দেয়, সেক্ষেত্রে ওই আসনগুলোতে সরাসরি ভোটের প্রয়োজন পড়বে। তবে এ ক্ষেত্রে দলভিত্তিক কোনও বণ্টন হবে না। সব দল বা জোট প্রার্থী দিতে পারবে।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৯ জানুয়ারি নব নির্বাচিতদের গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে ইসি। এতে ২৯৮ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নাম ঠিকানাসহ প্রকাশ করা হয়। এরপর ১০ জানুয়ারি (বুধবার) ২৯৮ জন সদস্য শপথ নেন। একটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত হওয়ায় ময়মনসিংহ-৩ আসনের ফলাফল ওই সময় ঘোষণা হয়নি। স্থগিত ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
অপরদিকে ভোট বাতিল হওয়া নওগাঁ-২ আসনের নির্বাচনের জন্য ইসি নতুন তফসিল ঘোষণা করেছে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ওই আসনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৩-সহ ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২২৩ ও জাতীয় পার্টি ১১টি আসনে জয়লাভ করেছে। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জিতেছে। অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি আসনে জয়লাভ করেছে।