চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত অন্যান্য প্রযুক্তি হলো জীবপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লক চেইন, ইন্টারনেট অব থিংস, ন্যানোটেকনোলজি, রোবটিকস, থ্রিডি প্রিন্টিং, ফাইভজি ও ক্লাউড কম্পিউটিং। জীবপ্রযুক্তিকে জলবায়ু সহনশীল কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি।
জীবপ্রযুক্তি হলো বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে বিভিন্ন ধরনের জীব ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণকর ও ব্যবহারযোগ্য প্রয়োজনীয় পণ্য বা প্রযুক্তি তৈরির বিশেষ প্রযুক্তি; যদিও প্রাচীন কাল থেকেই অ্যালকোহল, পনির, পাউরুটি ও দই তৈরিতে জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি গত পাঁচ দশকে বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। জীবপ্রযুক্তির সর্বশেষ উন্নয়নগুলোর মধ্যে একটি হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, যেখানে কাঙ্ক্ষিত উন্নতির জন্য জীবের জিনোমে একটি নতুন বৈশিষ্ট্য বহনকারী জিন প্রবেশ করানো হয়।
গত ৫০ বছরে ধান, ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, ক্যানোলা, পেঁপে ইত্যাদির বিপুলসংখ্যক ফসলের জাত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি দ্বারা উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ব্যাপক অবদান রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশসহ অনেক দেশে জিএম ফসল চাষ করা হয়। বাংলাদেশ কৃষকের জমিতে একটি পোকা প্রতিরোধী জিএম বেগুন চালু করেছে, যা কৃষক ও ভোক্তাদের কাছে ভালোভাবে গৃহীত হয়েছে।
কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য জীবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিনোম এডিটিং, ন্যানোটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো উন্নত প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। কৃষিকে লাভজনক করতে আধুনিক কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় নির্ভুল কৃষি অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে বহু বিভাগীয় বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করে প্রয়োজনভিত্তিক উন্নত গবেষণার জন্য অর্থায়ন করতে হবে। দেশের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে জিনোম এডিটিং, ন্যানোটেকনোলজি, অ্যাগ্রোপ্রসেসিং, ইন্টারনেট অব থিংসসহ উন্নত বিজ্ঞানের সংযোজন করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম আপডেট করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ন্যানোবায়োটেকনোলজি, জিনোম এডিটিংসহ এই সীমান্ত বিজ্ঞানগুলো অন্তর্ভুক্ত করে পাঠক্রম আপডেট করেছে। আইবিজিই প্রথমবারের মতো দিনের আলো চালিত রিচার্জেবল একটি ন্যানো ছত্রাকনাশক তৈরি করেছে, যা কার্যকরভাবে ধ্বংসাত্মক গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণ করে।
দেশের ৮.৭৭৪ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি, যার ৮৮ শতাংশ এরই মধ্যে চাষ করা হয়েছে। এর মানে চাষকৃত এলাকা সম্প্রসারণের সীমিত সুযোগ রয়েছে। তার ওপর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রের স্তর থেকে উদ্ভূত নগরায়ণ এবং সমুদ্রের জলের অনুপ্রবেশ প্রতিবছর কৃষিজমি ১ শতাংশ হ্রাস করছে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মাটি ও পরিবেশগত স্বাস্থ্যের অবনতি, উচ্চ উৎপাদন খরচ, আবাদযোগ্য জমি হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা।
জিন একটি জীবের নির্দিষ্ট কার্য, বিকাশ ও বংশগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জড়িত। মানুষের ডিএনএতে ২০-২৫ হাজারেরও বেশি জিন শনাক্ত করা হয়েছে। একটি জীবের কোষে সম্পূর্ণ জেনেটিক উপাদান বা ডিএনএ অণু একটি জিনোম হিসেবে পরিচিত। ক্রিসপার-ক্যাস জিনোম এডিটিং হলো একটি শক্তিশালী টুলবক্স, যা যেকোনো জীবের ডিএনএ/জিনোম সুনির্দিষ্ট ও নির্ভুলভাবে সম্পাদনা করতে ব্যবহৃত হয়। ক্রিসপার-ক্যাস জিনোম সম্পাদনা প্রযুক্তি সফলভাবে উদ্ভিদসহ অনেক জীবের জিনোম সম্পাদনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধরনের জিন এডিটিংয়ের ফলে নতুন ও কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। মাল্টিপ্লেক্স জিনোম এডিটিং ডিজাইন করে একটি উদ্ভিদের একাধিক বৈশিষ্ট্য একই সময়ে উন্নত করা যেতে পারে।
ক্রিসপার-ক্যাস জিনোম এডিটিং পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া নতুন উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাতগুলোর উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত দ্রুত ও সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃত। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক উদ্ভিদের জিনোম সম্পাদনা করা হয়েছে। দুটি জিনোম সম্পাদিত ফসল বর্তমানে বাজারে রয়েছে, উভয়ই ভোক্তা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এগুলো হলো সয়াবিন তেল (শুধু যুক্তরাষ্ট্রে) কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং গামা অ্যামিনোবুটারিক এসিডসমৃদ্ধ টমেটো (শুধু জাপানে), যা রক্তচাপ কমায়। সম্পাদনায় ব্যবহৃত প্রক্রিয়া ও ফলাফল পরিবর্তনের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে জিনোম সম্পাদনাকে প্রাথমিকভাবে এসডিএন-১, এসডিএন-২ ও এসডিএন-৩ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। জিনোম সম্পাদিত উদ্ভিদের এসডিএন-১ ও এসডিএন-২ শ্রেণিতে কোনো ট্রান্সজিন থাকে না এবং ক্লাসিক্যাল মিউটাজেনেসিস (উদাহরণস্বরূপ—গামা রশ্মি, রাসায়নিক মিউটাজেন) দ্বারা উদ্ভাবিত প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন জাতের থেকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু অত্যন্ত নির্ভুলভাবে এবং অল্প সময়ে এসডিএন-১ ও এসডিএন-২ ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জিনোম সম্পাদিত নতুন উদ্ভিদের জাতগুলো সরাসরি অনেক দেশে কৃষকদের চাষের জন্য দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে এরই মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন ও স্মার্ট ডায়াগনস্টিক পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছে। গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে—১. আইবিজিইর ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবনের জন্য গমের এস-জিন সম্পাদনার কাজ করছে। তারা এরই মধ্যে জিনোম নির্দিষ্ট প্রাইমার ও ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে গমের ব্লাস্ট ছত্রাক নির্ণয়ের জন্য একটি দ্রুত ও পয়েন্ট অব কেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। ২. বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সেরোটোনিন উৎপাদনকারী জিনগুলো অপসারণ করে পোকা প্রতিরোধী ধানের জাত এবং বিডিএইচ-২ জিন এডিট করে একটি উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে। ৩. ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যাবায়োটিক স্ট্রেস সহনশীল বেগুন ও ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছে। ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজি বিভাগ ধানের লবণাক্ততা সহনশীলতা উন্নয়নে কাজ করছে। বাংলাদেশের অন্যান্য ইনস্টিটিউটের গবেষকদের মধ্যে জলবায়ু স্থিতিস্থাপক প্রযুক্তির জন্য নির্ভুলভাবে এবং দ্রুততম সময়ে প্রজননের জন্য ক্রিসপার-ক্যাস জিনোম সম্পাদনার আগ্রহ বাড়ছে।
বৈপ্লবিক জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকারকে সক্ষমতা বৃদ্ধি, গবেষণার জন্য অর্থায়ন এবং যথাযথ নীতি ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জিনোম সম্পাদনার সঠিক ও সময়োপযোগী প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নেতৃত্ব দিতে পারে।