১৯৭০ সালের নির্বাচনে বৃহত্তর সিলেট থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্য ১১ জন, প্রাদেশিক পরিষদে ২১ জন। প্রাদেশিক পরিষদের দুজন ছাড়া ৩২ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ৩০ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এঁদের মধ্যে একজন আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেন। বাকি ৩১ জন (নন আওয়ামী লীগ দুজনও) মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন (এঁদের একজন মুক্তিবাহিনীর চীফ আতাউল গনি ওসমানী), প্রায় সকলেই ইয়ুথ ক্যাম্প ও রিফিউজি ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন, মুক্তিবাহিনীর রিক্রুট ও দেশের ভেতর অপারেশন পরিচালনায় গাইডের ব্যবস্থা করেন। এঁদের অনেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়, বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়, অনেকের স্বজন পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকারদের হাতে নিহত হন।
বৃহত্তর সিলেটের চারটি অংশেরই ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেন, অনেকে যুদ্ধের মাঠে শহীদ হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তালেব উদ্দীন, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুলেমান আহমদ। তৎকালীন বৃহত্তর ১৯টি জেলার চিত্রও মোটামুটি একই রকম হওয়ারই কথা। তবু দুইটা কমন অভিযোগ, আওয়ামী লীগ নেতারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে কলকাতার হোটেলে মৌজ ফুর্তিতে ব্যস্ত ছিলো/আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয়করণ করেছে। প্রথম অভিযোগটির অভিযুক্ত আসলে কারা, কোন কোন আওয়ামী লীগ নেতা, সেটার সুনির্দিষ্ট কোনো আলাপ অভিযোগকারীরা করেন না। দ্বিতীয় অভিযোগটি এক অর্থে সঠিক। আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক দল, কোনো জাতীয় মঞ্চ না।
রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সে তার দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। সমস্যা এসব সমালোচকদের নিয়ে নয়। সমস্যা খোদ আওয়ামী লীগকে নিয়ে। এসব সমালোচনার জবাব যে একেবারে খাঁটি তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে দেওয়া সম্ভব আওয়ামী লীগ সেটা জানে না বা গুরুত্ব দেয় না। প্রতিটি ইয়ুথ ক্যাম্প, রিফিউজি ক্যাম্প, মুক্তি বাহিনী গাইডেন্সে, কোথায় আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মী সংযুক্ত ছিলেন। প্রতিটি বৃহত্তর জেলায় ছাত্রলীগের কারা কারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা কারা কোথায় শহীদ হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, সব খুঁজে বের করা সম্ভব। কয়েক হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস বের করা যায় আর এতো মাত্র পঞ্চাশ বছর। কথা হলো এইসব কাজ কেন কেউ স্বেচ্ছাশ্রমে নিজের গরজে করতে যাবে? এসব কাজ করতে অনেক কিছু লাগে সময়, শ্রম, ডেডিকেশন। মোট কথা টাকা লাগে। টাকা ছাড়া ইতিহাসও সংরক্ষিত হয় না। আর যে ইতিহাস সংরক্ষিত হয় না, সে ইতিহাস লুট হয়ে যায়, এটাই স্বাভাবিক।
লেখক : হাসান মোর্শেদ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও কলামিস্ট।