1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

ব্যাংকিং খাত নিয়ে ভয়ের কিছু নেই

নিরঞ্জন রায় : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২

দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যখন চলছে গুজব ও অপপ্রচার, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা হচ্ছে দেশের ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম প্রশ্ন করা যাবে না। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে গুজব ও অপপ্রচার দূর করার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ রকম কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সেই পথেই হাঁটছে। দেশের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কেওয়াইসি অর্থাৎ নো ইওর কাস্টমার বা তোমার গ্রাহককে জানো এবং কাস্টমার অ্যাক্টিভিটি প্রফাইলের আওতায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ, বিশেষ করে ১০ লাখ বা তার বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে লেনদেন করলে সেই ব্যাংক শুধু অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্নই করবে না, এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদনও দাখিল করতে বাধ্য। কিন্তু এটি একটি স্বাভাবিক নিয়ম, যা স্বাভাবিক অবস্থায় মেনে চলা হয়।

দেশে যখন অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে বা দেশের অর্থনীতির প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন এই সাধারণ নিয়ম পালনে কিছু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত সব সময়ই নিতে হয়। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই হয়ে থাকে। এমনকি উন্নত বিশ্বেও এ রকম দেখা যায়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে, বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডায় আছে বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন। এখানে আমরা ১০ হাজার টাকা জমা দিতে গেলে ব্যাংকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয় এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়। অথচ এসব দেশের শত শত মিলিয়ন ডলার নিয়ে এসে বেগমপাড়া গড়ে তোলা হচ্ছে সবার গোচরেই। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা এলে এসব দেশের অর্থনীতির উপকার হয়—এ জন্য তারা এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করে না। এ কারণেই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতেও প্রয়োজন এবং বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্যই এই সুযোগে যেন জঙ্গি, সন্ত্রাসী বা ড্রাগ মানি ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবেশ না করে তা ব্যাংকারদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যাংলাদেশ ব্যাংক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে থাকা সত্ত্বেও এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু তাদের দূরদর্শিতাই দেখায়নি, সেই সঙ্গে তাদের শক্ত অবস্থানও তুলে ধরেছে। বর্তমান গভর্নর এমন সময় দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন সময়টা মোটেই তাঁর জন্য অনুকূলে নয়, বরং বেশ প্রতিকূলে। বিশ্বব্যাপী এক ধরনের অস্থিরতা এবং টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে চাপের মধ্যে আছেন উন্নত-অনুন্নত সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার থেকে ব্যতিক্রম নয় মোটেই। বরং আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং সমস্যার পাশাপাশি গুজব ও অপপ্রচারের মতো সমস্যাও সামাল দিতে হচ্ছে। এ রকমই কিছু গুজব ও অপপ্রচার শুরু হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে। প্রথমে অপপ্রচার চালানো হলো যে দেশে ডলার নেই এবং ব্যাংক এ জন্য এলসি খুলতে পারছে না। কথাগুলো একেবারেই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এ কথা সত্য যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী ডলার সংকটের কারণে অনেক দেশকেই আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে এবং আমাদের দেশেও একই অবস্থা হয়েছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। ডলারের ব্যবস্থা করতে পারলে ব্যাংক অবশ্যই এলসি খুলবে। যেমন—সাপ্লাইয়ারস ক্রেডিট, ব্যাংকের কাউন্টার পার্টি লিমিট ব্যবহার করে বা অন্য কোনো রপ্তানিকারকের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করতে পারলে খুব অনায়াসেই ব্যাংক এলসি খুলবে। অথচ অনেক ব্যাংক বিষয়টি এভাবে গ্রাহকদের কাছে উপস্থাপন না করে এককথায় বলে দিয়েছে যে ডলার নেই, আমরা এলসি খুলতে পারব না, যা ব্যাংকিং খাত এবং দেশের অবস্থা সম্পর্কে খুবই নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে।

ডলার সংকট কেটে উঠতে না উঠতেই আরেক ধরনের গুজব শুরু হয়েছে যে ব্যাংকে টাকা নেই এবং ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। এই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ব্যাংক নিয়ে বৃহৎ অঙ্কের আলোচিত ঋণদানের বিষয়ে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় বাংকে টাকা না থাকার অপপ্রচার আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এভাবে বৃহৎ অঙ্কের ঋণ প্রদানের ঘটনা আমাদের দেশে মোটেই নতুন কিছু নয়। এ রকম এর আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটতে থাকবে, যদি না দেশের ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ক্রেডিট অপারেশন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়। তবে এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না—এমন কথার কোনো ভিত্তি নেই। এই কথাগুলো যদি ঠিক হতো, তাহলে আল-বারাকা ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হতো অনেক আগেই। কিন্তু এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও ঘটার আশঙ্কা নেই। মোটকথা, ব্যাংক ঋণ প্রদান করে তার সঞ্চয়ের ৮০ শতাংশ এবং বাকি ২০ শতাংশই গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। কেননা এই ২০ শতাংশের বেশি অর্থ অর্থনীতিতে একসঙ্গে প্রয়োজন পড়ে না।

একটি বিষয় সবারই পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে আমাদের দেশের যে ব্যাংকিং কাঠামো, তাতে কোনো ব্যাংক বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। একটি ব্যাংক তখনই বন্ধ হয়, যখন সেই ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় বা অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। একটি ব্যাংক দেউলিয়া হবে দেউলিয়া আইন অনুযায়ী এবং অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয় প্রচলিত মারজার ও অ্যাকুইজিশন আইন অনুযায়ী। আবার একটি ব্যাংক দেউলিয়া হয় তখনই, যখন সেই ব্যাংক তাদের সঞ্চয়ের চেয়ে অধিক ঋণ দান করে বা অধিক মাত্রায় ফাটকা (স্পেকুলেশন) ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। যেমন—কোনো ব্যাংক যদি বাড়ির উচ্চমূল্যের বিপরীতে বেশি পরিমাণ মর্টগেজ ঋণ প্রদান করে থাকে।

২০০৮ সালে আমেরিকার আর্থিক খাতে ধস নামিয়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল। বেশ কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল এবং বৃহৎ ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার অন্যতম কারণ ছিল ব্যাংকগুলোর অতিমাত্রায় সাবপ্রাইম মর্টগেজ নামের ফাটকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা শুরু হওয়ার কথা শুনেই উন্নত বিশ্বের ব্যাংকগুলো ভয়ংকর দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে। এর কারণ ব্যাংকগুলো আবারও অধিক মাত্রায় বাড়ির উচ্চমূল্যে মর্টগেজ ঋণ প্রদান করেছে এবং বাড়ির মূল্যের যদি ভালো দরপতন হয়, তাহলে ব্যাংকগুলোকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। তা ছাড়া এখানকার ব্যাংক দেশের শেয়ারবাজারেও অনেক বিনিয়োগ করে থাকে, যা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ভালো ধাক্কা খেতে পারে। সেই বিবেচনায় আমাদের দেশের ব্যাংকের এসব কোনো কিছুই নেই। যেমন—উল্লেখযোগ্য মর্টগেজ ঋণ নেই। শেয়ারবাজারেও তেমন বিনিয়োগ নেই। তা ছাড়া দেশে দেউলিয়া আইন বা মারজার এবং অ্যাকুইজিশন আইনও সেভাবে কার্যকর নেই। ফলে আমাদের দেশের ব্যাংক বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ আমি অন্তত দেখি না। আর ব্যাংক যদি বন্ধ না হয়, তাহলে ব্যাংক তার আমানতকারীর টাকা সব সময়ই ফেরত দিতে পারবে। এ নিয়ে কারো মনে কোনো রকম সংশয় থাকা উচিত নয় এবং এসংক্রান্ত কোনো গুজবেও কান দেওয়া উচিত নয়।

আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, তা হচ্ছে আইনের বাইরেও আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাত বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা ভোগ করে থাকে। এখানে ব্যাংক বন্ধের ব্যাপারে সরকার সব সময়ই একটি সামাজিক চাপে থাকে। এটা অবশ্য কেবল আমাদের দেশেই নয়, উন্নয়নশীল অনেক দেশেই হয়ে থাকে। যে কারণেই হোক না কেন, কোনো ব্যাংক বন্ধের উপক্রম হলে দেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিধায় সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে সরকারকে এগিয়ে এসে সেই ব্যাংককে রক্ষা করতে হয়। এ কারণেই শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নয়নশীল অনেক দেশেই ব্যাংক সহসা বন্ধ হতে দেখা যায় না। এর দৃষ্টান্ত তো আমাদের দেশেই আছে। গত শতকের আশির দশকে বিসিআইসি ব্যাংক রাতারাতি বন্ধ হয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে তাদের ঢাকার শাখাও বন্ধ হয়ে যায়। এটি একটি বিদেশি ব্যাংক ছিল, যা বিদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে বন্ধ হয়েছিল এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছুই করার ছিল না। তার পরও সরকার এগিয়ে এসে সেই বিদেশি ব্যাংকের ঢাকা শাখার পাশে দাঁড়িয়েছিল। যাঁরা দেশের ব্যাংকের প্রতি আস্থা না রেখে বিদেশি ব্যাংকের শাখায় অর্থ রেখেছিলেন, তাঁদের টাকা সরকার যেভাবেই হোক ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ছিল এবং দিয়েছিলও। সরকারের এই সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণেও আমাদের দেশের ব্যাংক বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই এবং এই একই কারণে ব্যাংকের গ্রাহকদের অর্থ ফেরত না পাওয়ার কোনো শঙ্কাও থাকা ঠিক নয়।

অনেকেই বলবেন, আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতে কি কোনো সমস্যা নেই? অবশ্যই অনেক সমস্যা আছে; যেমন—খেলাপি ঋণ, সুশাসনের বা দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব, দক্ষ ও পেশাদার ব্যাংকারের অভাব, ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত ডিজিটাইজেশনের অভাবসহ বেশ কিছু সমস্যা নিশ্চয়ই আমাদের ব্যাংকিং খাতে আছে এবং বেশ প্রকট আকারেই আছে। আর এগুলোর সমাধান অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু এগুলো ব্যাংকিং খাতের নিয়মিত সমস্যা, যা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে দীর্ঘ ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে এবং রাতারাতি এই সমস্যা দূর করাও সম্ভব নয়। আর এখন চলছে সংকটকাল, তাই এখন এই সমস্যা নিয়ে হৈচৈ করার সময় নয়। এখন সংকটকাল সামাল দেওয়ার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তা-ই আগে করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো সেই কাজটাই করছে এবং তাদের সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা তাদের শক্ত অবস্থান তুলে ধরতে পেরেছে। তাই ব্যাংকিং খাত নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি শুধু গভর্নর মহোদয়কে অনুরোধ করব, আপনি এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে আয়কর রিটার্ন সংক্রান্ত যে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার উদ্যোগ নিন। প্রয়োজনে আপনি বিষয়টি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনুন, দেখবেন এই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে এবং তখন ব্যাংকের প্রতি মানুষের শতভাগ আস্থা থাকবে, যেমনটা এর আগেও ছিল।

লেখক : নিরঞ্জন রায় – সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা


সর্বশেষ - রাজনীতি