1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

স্বাধীনতার সংগ্রাম আর মুক্তির স্বপ্ন

রাজেকুজ্জামান রতন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১

ঘোষণা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার। পরাধীনতার গ্লানি মানুষ বুঝতে পারে তখনই যখন দেখে পদে পদে বৈষম্য, মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে চলার পথে শত বাধা আর প্রকট বিচারহীনতা। তখন তার কাছে স্বাধীনতার চাইতে প্রিয় আর কিছু হতে পারে না। আর শোষণ থাকলে বৈষম্য থাকবে, বৈষম্য থাকলে মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে এবং মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। তারা অসহায় হয়ে পড়বে ক্ষমতাসীনদের কাছে।

ক্ষমতাসীনরা দয়া করবেন মাঝে মাঝে আর প্রতিবাদের ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখলেও দমন করবেন নিষ্ঠুর পন্থায়। এসব জেনেও মুক্তি পাবার আশায় স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরা। রাজনীতি দিয়ে মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছেন, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দিয়েছেন। এরই চূড়ান্ত পর্বে আকাশচুম্বী আশা নিয়ে, সাগর পরিমাণ রক্ত দিয়ে, প্রতিজ্ঞা আর সাহসে ভর করে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছিল মুক্তিযোদ্ধারা।

কাঁধে রাইফেল, মুখে বিজয়ের উল্লাস নিয়ে আর সবুজের বুকে লাল বৃত্ত আঁকা পতাকা উড়িয়ে যখন তারা দেশে মার্চ করছিল তখন সন্তানহারা মা যেমন তার বেদনা ভুলে গিয়েছিল তেমনি সম্ভ্রমহারা বোনটি মাথা উঁচু করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছিল। ভেবেছিল সবাই, এবার দেশটা আমাদের হবে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, মনে হয় এই তো সেদিন। কিন্তু সময়ের হিসাবে পার হয়ে গেছে ৫০ বছর। বাংলাদেশ পালন করছে সুবর্ণজয়ন্তী। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয় বরং অনেকেই বলছেন বিস্ময়কর। যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতির চিত্র দেখি তাহলে দেখব মাথাপিছু আয় ১১০ ডলার থেকে বেড়ে এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার, জিডিপি ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে হয়েছে ৩৩৫ বিলিয়ন ডলার।

খাদ্য উৎপাদন ১ কোটি ১০ লাখ টন থেকে বেড়ে ৫ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। অন্তত ১৩টি ক্ষেত্রে উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষস্থানে আছে বলে তথ্যে জানা যায়। ধান উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ মাছে প্রথম, তৈরি পোশাকে দ্বিতীয়, প্রবাসী আয়ে অষ্টম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলুতে ষষ্ঠ, কাঁঠালে দ্বিতীয়, আমে অষ্টম, পেয়ারায় অষ্টম, পাটে দ্বিতীয়, মিঠা পানির মাছে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ আর ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, আউট সোর্সিংয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। এ ছাড়াও যমুনা সেতু, হাইওয়ে, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং সর্বশেষ পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অগ্রগতিকে দৃশ্যমান করেছে।

প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনে এই ভূখণ্ডের মানুষের বুকে পরাধীনতার গ্লানি আর চোখে স্বাধীনতার স্বপ্নে সংগ্রাম করেছে । ব্রিটিশরা কৌশলে দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার যে বীজ বপন করে তার ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠে পাকিস্তান। পৃথিবীর কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে দেশ হয়নি। যদি তা হতো তাহলে এশিয়া আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল মিলে একটি মুসলিম দেশ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি।

ইউরোপের সবগুলো দেশ মিলে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দেশ হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া মিলে যেমন বৌদ্ধ ধর্মের দেশ হয়নি তেমনি ভারত নেপাল মিলে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের দেশ হয়নি। কারণ দেশ হতে গেলে ভূখণ্ডগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক বন্ধন, ভাষা, অর্থনৈতিক জীবনধারা প্রভৃতি দরকার হয়। যে কারণে এক ধর্মের মানুষ হলেও তাদেরকে নিয়ে এক দেশ হয় না। তাই হাজার মাইলের ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষা সংস্কৃতির পার্থক্য নিয়ে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামের যে দেশ গড়ে তোলা হয় তা কোনো বিচারেই এক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল না।

এই কৃত্রিম রাষ্ট্র ঐক্য প্রতিষ্ঠার নামে যেসব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিল তাতে মোহভঙ্গ হতে বেশি দেরি লাগেনি। ভাষার উপর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ৫২, শিক্ষার অধিকার সংকুচিত করার প্রতিবাদে ৬২, সংস্কৃতির উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে ৬৫, ৬ দফার লড়াইয়ে ৬৬, সামরিক শাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ৬৯, মানুষের বিপুল অংশগ্রহণে নির্বাচনে ধস নামানো বিজয় ৭০ এবং ৭১-এর সশস্ত্র লড়াই ধারাবাহিকভাবে আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।

পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র তার বিপরীতে ধর্মনিরপেক্ষতা, পাকিস্তান ছিল সামরিক শাসন দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র তার বিপরীতে গণতন্ত্র, ব্রিটিশ শোষণ ও পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শোষণের বিরুদ্ধে শোষণ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে সমাজতন্ত্র আর দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি প্রায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ, এই আকাঙ্ক্ষাগুলো মূর্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের চেতনায়। তাই ঘোষণা করা হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে আমাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে সব পথ যেন মিশে গিয়েছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, স্বাধীনতার মোহনায়।

৫০ বছর পরে আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গেলে দেখা যাবে অনতিক্রম্য এক বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল যারা আর সুফল ভোগ করছে যারা, তারা একই দেশের মানুষ হয়েও যেন এক জাতের মানুষ নয়। দুজন বাঙালি কোটিপতি নিয়ে যে দেশের যাত্রা শুরু সে দেশে আজ সোয়া লাখের বেশি কোটিপতি।

এদের মধ্যে আবার ২৫০ জন যেকোনো দেশের বিবেচনায় অতি ধনীর পর্যায়ে পড়ে। শ্রমিক এবং প্রবাসী শ্রমিকের শ্রমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু এর পাশাপাশি যে চিত্র আমাদেরকে পীড়িত করে তা হলো, প্রায় দেশের ৭ কোটি শ্রমজীবী মানুষ যাদের মজুরি বিশ্বে সবচেয়ে কম, এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী তাদের শ্রম বিক্রি করছেন বিদেশের বাজারে, দেশে বেকারত্ব এত তীব্র, যেকোনো একটা কাজ পাবার জন্য যুবকরা মরিয়া হয়ে জীবনের ও আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে বিপৎসংকুল ও অনিশ্চিত পথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে।

কৃষক ধান, সবজি, মাছ, ফল চাষ করে ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। অন্যদিকে বাজার সিন্ডিকেটের কারণে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছেই। শিক্ষা এবং চিকিৎসাব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে। ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের নিত্য নতুন খবর আসছে, প্রতি বছর গড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করছে ধনীরা, সে টাকা জমছে বিদেশের ব্যাংকে। মানুষ দেখছে দেশের জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, বৈষম্য আর দুর্নীতি সবই বাড়ছে। তখন প্রশ্ন আসে, ৫০ বছর পর এই দৃশ্য আমরা কি দেখতে চেয়েছিলাম?

ধর্মকে ভোটের কাজে ব্যবহার করা ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৎপরতা দুটোই বেড়েছে, ক্ষমতার স্বার্থে এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির উন্মাদনা বাড়ছে।

সাম্যের পরিবর্তে অসাম্য এখন প্রধান ধারা, ফলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আকাশচুম্বী। সামাজিক ন্যায়বিচার এখন মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মানবিক মর্যাদা যে ভূলুণ্ঠিত তা নারীর লাঞ্ছনা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর আক্রমণের চিত্র দেখলে বোঝা যায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং চর্চা এখন সবচেয়ে নিম্নস্তরে তাই নির্বাচন গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ না গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধ ধ্বংসের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ আর আমাদের বিজয়ের প্রাক্বালে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এবার তারা মুক্তি পাবে শোষণ ও লুণ্ঠন থেকে, আর মাথা নিচু করে থাকা নয়, মর্যাদা নিয়ে বাঁচার মতো পরিবেশ পাবে। তা এখনও অর্জিত হয়নি। এর কারণটা খুঁজে বের না করলে হতাশা গ্রাস করবে এবং ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র।

স্বাধীনতার পর যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যা ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে তার ফলেই শোষণ ও বৈষম্য এত প্রকট রূপ নিয়েছে। একারণেই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি কিন্তু শোষকদের প্রাপ্তি ঘটেছে ব্যাপক। শোষণ ও লুণ্ঠনকে অব্যাহত রাখতেই নিপীড়ন যেমন বাড়ছে, শোষণকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাও তেমনি প্রশ্রয় পাচ্ছে। ফলে উন্নয়নের এই প্রবল জোয়ারেও গণতন্ত্র ও নৈতিকতার ভাটার টান মানুষ প্রত্যক্ষ করছে।

পাকিস্তানি প্রায় ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে জনগণ লড়েছে ২৩ বছর আর ৫০ বছর পার করেছে স্বাধীন দেশে। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের পরিবর্তন দেখতে দেখতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেছেন আবার মুক্তিযুদ্ধের পর পর যারা জন্মগ্রহণ করেছিলেন তারা প্রৌঢ় থেকে বার্ধক্যের পথে যাত্রা করেছেন।

তাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে সেদিনের সেই সংগ্রাম আর স্বপ্নের দিনগুলো। কিন্তু আজ ঝলমলে দালান কোঠা-হাইওয়ে, রাস্তা-ফ্লাইওভার, ব্রিজ-মেট্রো দেখে মাথাপিছু আয়, জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কথা শুনে রাগ ও হতাশায় বলছেন, এতে আমার কী? কারণ তারা চোখে দেখছেন বৈষম্য, গণতন্ত্রের বেহাল দশা আর নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র।

বিজয় অর্জন করলেও জনগণ বিজয়ী হতে পেরেছে কি না সে প্রশ্ন এখনও থেকেই যাচ্ছে। ৭২ সালে যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল তাতে কিছু দুর্বলতা থাকলেও একথা তো স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল যে রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে রাষ্ট্রধর্ম, সমাজতন্ত্রের বদলে পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতি, জাতীয়তাবাদের বদলে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া তো জনগণ ৫০ বছরে প্রত্যক্ষ করছে। আর গণতন্ত্রের বেহাল দেখছে প্রতিদিন।

গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ নির্বাচন। ৫০ বছরেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার আইন ও প্রক্রিয়া চালু করা গেল না। বরং তা এখন জটিল রোগে আক্রান্ত বলে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন। তিনি আবার বলেছেন, স্বাধীনতার ৫ দশক পরে আমরা কি অন্ধকার ঘরে কালো বিড়ালের মতো গণতন্ত্রকে খুঁজছি?

আর বাকস্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘‘তরুণ বয়সে আমি একটি লেখা এক ঘণ্টায় লিখে ফেলতে পারতাম। এখন এক সপ্তাহ লাগে। আমাকে বারবার ভাবতে হয় কী লিখছি।” এর অর্থ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা দুটোই আজ বিপন্ন! গত ৫০ বছরে সচিব, জেনারেল, কোটিপতি তো কম পেলাম না, অর্থনৈতিক অবকাঠামো নিয়ে উচ্ছ্বাস কম করছি না কিন্তু যা পেতে চেয়েছিলাম সেই স্বাধীনতা কি অধরা আর মুক্তি কি দূরেই থেকে গেল?

লেখক: রাজেকুজ্জামান রতন, রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


সর্বশেষ - রাজনীতি