1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি

ডেস্ক রিপোর্ট : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৩

আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নানা মন্তব্য কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিভাজন ও উস্কানির বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বহু আলোচনা হয়েছে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের কর্মপরিধির সীমানা ডিঙিয়ে মন্তব্য করা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। কারণ একেকটি দেশের স্বকীয় সংস্কৃতি, সমাজকাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ওই দেশটির নিজস্ব থেকে সৃষ্ট। ফলে দেশের যেকোনো জাতীয় স্বার্থ বিষয়ক কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রিত হয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। তার পরও কূটনৈতিক, জাতীয় ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় অনেক সময় বিদেশিরা মন্তব্য করে থাকেন। গ্লোবালাইজেশনের সময় আমাদের প্রায় সব রাষ্ট্রের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। এ সম্পর্কের মাত্রা কেমন তা কূটনৈতিক তৎপরতা, দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসায়িক সম্পর্ক, নীতিগত সম্পর্কসহ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। তার পরও অনেক উন্নয়নশীল, ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের প্রতি বিদেশিদের আলাদা দৃষ্টি থাকে। তাদের স্বার্থ তো রয়েছে এবং এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ভূরাজনীতির একাধিক সমীকরণ। এ দুটি কারণ বাদে আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত কারণেও বিদেশিরা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করে বসেন। দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে তাদের কথা বলার সুযোগ করে দেন রাজনীতিকরাই দেশের স্বার্থ প্রাধান্য না দিয়ে।

উপমহাদেশের রাজনীতির কাঠামো ও স্বরূপ বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্ত থেকে ভিন্ন। আফ্রিকার ঘন ঘন স্বৈরতন্ত্রের বা সামরিক শাসনের ছায়ার বিস্তারের মতো নেতিবাচক কিছু এখানে নেই। এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। কিন্তু এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বিভাজন; যা দুঃখজনক বাস্তবতা। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বদলে রাজনীতিতে আবেগসর্বস্ব সিদ্ধান্তের প্রাধান্য অনেক বেশি। ফলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এত ঘাটতি থাকার পরও এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অর্জনও কম নয়। বরং বলতে হবে অনেক বেশিই। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা বিদেশিদের থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। বিদেশিরা কখনও আমাদের কোনো সমস্যার সমাধান করে দেননি। উলটো অনেক সমস্যা উস্কে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গ কিংবা ছিটমহল ভাগের প্রসঙ্গ টেনে আনা যেতে পারে। তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব এখনও আমাদের ভোগাচ্ছে। তাই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিদেশিদের কাছে মদদ পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিকদের স্বার্থ ও প্রয়োজনেই গঠনমূলকভাবে ভাবতে হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশ নিয়ে ফের মুখোমুখি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার স্পষ্ট বক্তব্য, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ওয়াশিংটন হস্তক্ষেপ করছে এবং ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করছেন। রাশিয়ার মুখপাত্র মারিয়া জাকারভারের এ বক্তব্যের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইভেলির সংবাদমাধ্যমে পাঠানো প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না এবং কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতিত্বও করে না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ বিষয়ে রাশিয়ার বক্তব্য তাদের ধারাবাহিক অপব্যাখ্যার অংশ।’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মন্তব্যের সমালোচনা করে রাশিয়া এবারই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে এমনটি নয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দুই বছর ধরেই বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু আয়োজনের তাগিদ দিয়ে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। এ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন ব্যক্তিদের জন্য ঘোষিত ভিসানীতিও ইতোমধ্যে প্রয়োগ শুরু হয়েছে।

ভিসানীতির আওতায় আসবে গণমাধ্যম এমন কথাও জানা গেছে তাদের তরফেই। ভূরাজনৈতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনো অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন রাশিয়াও নানাভাবে তৎপরতা বাড়ায়। আধিপত্যের এ লড়াইয়ের ক্ষেত্র যেন এবার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে। শুধু ক্ষমতার দ্বন্দ্বই নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারি বেড়েছে রাশিয়ার। বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে রাশিয়া। ফলে এখানে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে। অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনায় তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করবে এমনটিই স্বাভাবিক। তবে যেভাবে এক দেশের কূটনীতিক অন্য দেশের কূটনীতিককে বিবৃতির মাধ্যমে সমালোচনা করেছেন তা নজিরবিহীন। ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব যে কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছে তার একটি বড় প্রমাণ এটি। এটা কোনোভাবেই অসত্য নয়, ৫২ বছরের বাংলাদেশ এখন নানা কারণে অনন্য উচ্চতায়।

ভূরাজনৈতিক দ্বন্দের স্বার্থেই যে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিদেশিরা প্রায় মন্তব্য করেন তা-ও অস্পষ্ট নয়। গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অন্যতম প্রধান অর্থনীতির দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব ক্রমেই বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিস্তার ঠেকাতে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত। ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন অনেকটাই ভালো। তার পরও বাংলাদেশের রয়েছে বাড়তি গুরুত্ব। চীনের সঙ্গে ভারতের কাশ্মির, লাদাখ ও তিব্বত বিষয়ে বৈরিতা আছে। এ অঞ্চলে ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানের পুরোনো ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীন। রাশিয়া আমাদের উন্নয়ন সহযোগী ও পুরোনো মিত্র। ভারত মহাসাগরে চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাও পাচ্ছে ভারত। তাই মালাক্কা প্রণালিতে ভারত যদি চীনকে চাপে ফেলে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে চীনের খুব প্রয়োজন। কারণ মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হলে বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের সমুদ্র ও স্থল বন্দর তখন চীনের জন্য খুবই দরকারি হয়ে পড়বে। চীনের বাণিজ্যিক নিরাপত্তার জন্য যেহেতু বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ, এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের হিসাবে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি, রাশিয়া আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। এসব হিসাবের মধ্যভাগে পড়েছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে মুক্তি ও উন্নয়ন মডেল পূর্ব ও পশ্চিমের নেতাদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত। বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন নির্ভরশীল বিশ্বব্যবস্থায় নানান বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও কাজ করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক অগ্রগতির কারণেও বাংলাদেশ এখন আর নির্ভরশীল রাষ্ট্র নয়। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং স্বকীয় বৈশ্বিক সিদ্ধান্তে অংশ নেওয়ার সক্ষমতাও বাংলাদেশের রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট যদি তীব্রতর হয়ে ওঠে তাহলে তা আমাদের অর্থনীতি ও অগ্রগতি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মন্তব্য না করাই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বৈশিষ্ট্য। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেমন বিভাজনের তেমন অস্বীকারেরও। ক্ষমতায় যে-ই আসে তাকেই অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দেওয়ার একটি ধারাবাহিকতা বিরোধীদলীয় নেতাদের বক্তব্যে পাওয়া যায়। বিভাজনের ফলে সমন্বিতভাবে কাজ করার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। দেশের উন্নয়ন সবার কাছেই কাঙ্ক্ষিত। দেশের উন্নয়ন মানে জনজীবনের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন। এ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার নেতৃত্ব রাজনীতিকরা দিয়ে থাকেন। তারা এখানে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু রাজনীতিকদের মধ্যে বিভাজন থাকলে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে অন্যকে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের প্রবণতার ফলে সুষ্ঠু আলোচনার সুযোগ তৈরি হয় না। অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রয়োজন একতা। রাজনৈতিক দলগুলো যখন সংঘাত-সহিংসতামূলক কর্মসূচি ঘোষণা করে তখন জনমনে শঙ্কার পাশাপাশি দুর্ভোগ বাড়ে। আমরা কঠিন সময় পার করছি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের নামে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। যারা দিন আনে দিন চালায়, তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছে না।

আমাদের সংকট আমরাই সমাধান করতে পারি। বিদেশিদের হস্তক্ষেপ অতীতে প্রয়োজন হয়নি, এখনও প্রয়োজন নেই। কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে সংঘাত-সহিংসতাময় পরিস্থিতি সম্পর্কে বিদেশি সম্প্রদায়কে অবহিত করা হচ্ছে। এ সংকট সমাধানের জন্য বিদেশিদের অবহিত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমাদের যে সমস্যাগুলো রয়েছে তা জটিল মনে হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতির কারণে। এ সমস্যাগুলো আমাদের সার্বিক প্রয়োজনেই নিষ্পত্তি করতে হবে। বাইরের কাউকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দিলে বিভাজন বাড়ার আশঙ্কা আরও বেশি থাকে। যদি আলোচনায় কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন হয় তা-ও নিজেদের মধ্য থেকেই বাছাই করতে হবে। গঠনমূলক আলোচনা এবং জনসংবেদনশীল রাজনৈতিক কর্মসূচিই ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল পুনর্নির্ধারণ নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। সব অনিশ্চয়তাই কাটানো সম্ভব যদি শর্তহীন সংলাপের মাধ্যমে সংকট নিরসনের কাঠামোগত পথ খুঁজে বের করা যায়।

লেখক: ড. মো. আব্দুল্লাহ হেল কাফি – অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - রাজনীতি