1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

শহীদ ডা. মিলন ও দেশের গণতান্ত্রিক ধারা

নিউজ এডিটর : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩

শহীদ ডা. মিলন একটি অবস্মরণীয় নাম। একটি ইতিহাস। গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগের এক মহিমান্বিত নাম। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। এই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর শহীদ ডা. মিলন দিবস পালিত হয়ে আসছে। ডা. মিলনের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। অল্প কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। হাজারো সংগ্রাম, অসংখ্য আত্মত্যাগ ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় ঐতিহাসিক সংগঠন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ)। চিকিৎসক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুমূর্ষ মানুষের সেবায় সদাব্যস্ত এ সংগঠনের সদস্যরা। এদেশের মানুষের কাছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পথিকৃত বিএমএ। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ঢাকা মেডিকেলের পার্শ্বে সুউচ্চ শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, ৬৯-এর গণ আন্দোলন এবং ৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ সংগঠনের সংগ্রামী সেনারা নির্ভীক আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রক্তদানকারী চিকিৎসকরা অন্যদের সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। সেই গৌরবময় ইতিহাস ও পূর্বসূরীদের অনুপ্রেরণায় ডা. শামসুল আলম খান মিলনসহ আমরা সেই বিএমএ-র সদস্য হতে পেরে সত্যিই গর্বিত।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ সকল পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন; স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তের সেই জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ। আবারো এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। সেই স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্র উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল। ১৯৯০ সাল ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সকল মতের, পেশার মানুষ। লক্ষ্য একটাই ছিলো স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রের উত্তরণ। তাই ঢাকা শহর সে সময় পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ২৩ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচারের দোসর ডা. জাফর উল্লাহ গংদের সহায়তায় ১৯৯০ সালে এদেশের জনগণের ওপর টিক্কা খান সরকারের মত চাপিয়ে দেওয়া হয় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে অন্য সকল পেশাজীবিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনকে আরো বেগবান করে। অতঃপর এলো ২৭ নভেম্বর ১৯৯০। সারাদেশে স্বৈরাচার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএ-র নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহুত চিকিৎসক সমাবেশ। এতে যোগদানের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন বিএমএ-র মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্ম-সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন।

পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমের সময় তাদের রিকশা লক্ষ্য করে গুলি চালায় সামরিক জান্তাবাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. মিলন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে রিক্সায় করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে। সেখানে জরুরি চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। সকলকে কাঁদিয়ে তার প্রিয় মেডিকেল কলেজেই শহীদের বেশে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। অথচ এই কলেজেই তিনি পড়েছিলেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছিলেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে। ডা. মিলন শহীদ হওয়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান হয় এবং অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। স্বার্থক হয় মিলনের আত্মদান।

শহীদ ডা. মিলন এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম। ১৯৫৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নশিপ চলাকালীন তিনি ইন্টার্ন চিকিৎসক সংগঠনের আহ্বায়ক হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন বিএমএ নির্বাচনে মিলন যুগ্ম-সম্পাদক ও আমি দপ্তর সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। সেই থেকে একইসঙ্গে সংগঠনের হয়ে কাজ করতাম। দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে আমরা নির্বাচিত হলেও বিএমএ-র কাজে বা পেশাগত কোনো বিষয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। একে অপরের সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে পেশার জন্য অটল থেকে কাজ করেছি। চিকিৎসকদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি, যা তার নির্বাচিত হয়ে আসা থেকেই প্রতীয়মান হয়।

১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিএমএ-র বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি ও স্বৈরশাসকের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে সকল চিকিৎসক সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন মঞ্চ থেকে নেমে আমি আর মিলন এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওই সময় বিবিসি রেডিও থেকে টেলিফোনে বিএমএ নেতাদের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসি রেডিওতে আমার যে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়, তাতে মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয় কথা বলতে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ২৭তম শাহাদাত বার্ষিকীতে আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ। এদেশের হাজার হাজার চিকিৎসকদের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল।

মাঝে মধ্যে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র আজ সুসংহতি। ডা. মিলন যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রাম করতে করতে আত্মহুতি দিয়েছিলেন, অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিন মেয়াদে দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করেছে। এই দিবসে প্রত্যাশা-বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োাজিত চিকিৎসক কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশার বা ক্যাডারের মধ্যে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করবে। কর্মস্থলে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান প্রয়োজন ও চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণসহ স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন, এছাড়াও চিকিৎসকদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রবর্তন, স্বাস্থ্য বীমা, হেলথ্ কমিশন গঠন সময়ের দাবি। গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট উন্নত চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য ও সম্প্রসারিত হবে। মিলনের বিদেহী আত্মার শান্তিতে থাকুক এই কামনা নিরন্তর। একই সঙ্গে জোর দিয়ে বলতে চাই যে শহীদ ডা. মিলন দিবস বর্তমান প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গণতন্ত্রকে ব্যাহত করতে দেশি-বিদেশি নানা তৎপরতার সঙ্গে রয়েছে অশুভ শক্তির অতৎপরতা। যে কারণে দেশে গণতন্ত্র আজ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। একমাত্র সংবিধান অনুযায়ী যথাযথ সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই রক্ষা পাবে গণতান্ত্রিক ধারা। আমাদেরকে দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এই হোক আজকের দিনে শহীদ ডা. মিলন দিবসে শপথ।

লেখক : অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ – উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - রাজনীতি