1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাচ্চারা কেন জীবন-জীবিকা নামের ডিসকোর্স পড়বে?

নিউজ এডিটর : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩

একজন নারীর চার মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডের ভিডিওটা চারবার শুনেছি এবং কোনো কনক্লুডিং রিমার্ক পাইনি যে উনি আসলে কী বলতে চেয়েছেন বা উনার মূল রেকমেন্ডিং পয়েন্ট কী। ভাইরাস যতো কম ছড়ায় ততোই মঙ্গল। তবে ‘চিল্লায়া মার্কেট ফাওন যাইত ন’ শ্লোগান এই ভদ্রমহিলা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন। উনি ‘চিল্লায়া মার্কেট’ পেয়ে গেছেন। প্রচুর লাইক, শেয়ার, মার্কেট। কারণ এই দেশের ৯৫ শতাংশ অভিভাবক এই নারীর মতো করেই ভাবেন। কেন জানেন? এই নারীর মতো প্রায় সব ‘সচেতন’ অভিভাবকই আমাদের প্রচলিত কারিকুলামেরই প্রোডাক্ট, যে কারিকুলাম আমাদের গিলিয়েছে ফুটা চৌবাচ্চার অংক, সরল সুদ কষা, বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠানামার বুজরুকি এবং প্রাইভেট স্যারের সাজেশন। প্রোডাক্টিভ এডুকেশন বা লাইফ স্কিলস এই শব্দগুলার সঙ্গে আমাদের আব্বা-আম্মাদেরও পরিচয় ঘটেনি, আমাদেরও ঘটেনি।

সুতরাং নতুনকে আমরা ভয় পাচ্ছি- এটা হতেই পারে। তা বলে এই রোবটিক এডুকেশনের যুগে, যেখানে একই দেশে চলমান আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন কারিকুলামে শিক্ষার্থিরা শিখছে মুক্তিকামী শিক্ষার সূত্র, তৈরি হচ্ছে মহাকাশ নিয়ন্ত্রণের জন্য, সেখানে এই অভিভাবকরা এখনো তাদের বাচ্চাদের তৈলাক্ত বানরের বাঁশ বাওয়াতে চাচ্ছেন কেন সেটি আমার বোধগম্য নয়। এতো বছরের জং ধরা অচল দেয়াল ভাঙার ভয়? নাকি নিজে যা শেখেননি, সেটা সন্তান শিখে ফেললে, সন্তান প্রশ্ন করতে শিখে গেলে, তাকে ‘তুমি আমার চেয়ে বেশি জানো’? বলে দমিয়ে রাখতে না পারার ভয়ে ভীত ইনসিকিউর প্যারেন্টহুড। যাই হোক, পুরো ভিডিও শুনে কমপ্লেইনিং পয়েন্টে এই নারীর তিনটে বক্তব্য পেলাম।

বাচ্চারা কেন জীবন ও জীবিকা নামের ডিসকোর্স পড়বে বা বাচ্চারা ডিম ভাজা কেন শিখবে? বাচ্চারা এসব শিখবে না। শিখলেও মেয়ে বাচ্চারা এসব ঘরেই শিখে নেবে। কারণ মেয়ে বাচ্চার জন্মই হয়েছে বান্দিগিরি করার জন্য। আর ছেলে বাচ্চারা তো ঘরে স্কুলে কোথাওই ডিম ভাজা শিখবে না। কারণ তাদের জন্য এই নারীর মতো অনেক ‘সচেতন’ নারীই আইনসিদ্ধ বান্দি তৈরি করছেন। সুতরাং রান্নাবাটি শেখা বাদ। ওকে? ডান।

এই পয়েন্ট তো আরও বিরাট সমস্যার। বাচ্চারা ‘এসো বন্ধু হই’ কেন পড়বে? স্কুলে কি বন্ধুত্ব শেখাতে বেতন দেয়া হয়? এমনিতেই বেচারী মায়েরা বাচ্চার প্রেম থামাতে পারছেন না, তার উপর ঘটা করে বন্ধুত্ব শিখলে ঘরে ঘরে তো প্রেমের আগুন জ্বলবে। সুতরাং এই অধ্যায় বাদ দিতে হবে। বাচ্চারা বন্ধু হবে না। বাচ্চারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের চিপায় ঢুকবে, সিনেমা হলের আঁধারে চুম্মাচাটি করবে, লুকিয়ে লিটনের ফ্ল্যাটে যাবে। কিন্তু ‘এসো বন্ধু হই’ পড়তে পারবে না। ওকে, ডান।

এটাই মূল সমস্যা। বাচ্চারা মাসিক নিয়ে কেন পড়বে? কেন বাচ্চারা বয়সন্ধিকালীন শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক অস্থিরতা এসব বিষয় স্কুলে শিখবে? এসব কি বইতে শেখার কথা। এসব তো এমনিতেই শিখে যাবে। কাভি কাভি নেহি। কোনো অবস্থাতেই না। বাচ্চারা এসব স্কুলেও শিখবেনা, মা বাবার কাছেও শিখবেনা। বাচ্চারা এসব শিখবে রাস্তার ক্যানভাসারারের কাছে বা বাড়িতে চাচতো খালতে মামতো বোন থাকলে তাদের গা হাতাবে বা কাঁথার নিচে লুকিয়ে মোবাইলে পর্নো দেখবে। এগুলোই সবচেয়ে ভালো এবং নিরাপদ। তাই না? এপার্ট ফ্রম জোক, এই ইস্যুটা কিন্তু সিরিয়াস। এই দেশে ঘরে ঘরে ধর্ষক বা ধর্ষকামী পুরুষ তৈরি হয় এই নারীদের মতো অভিভাবকদের কল্যাণে।

তারা বিশ্বাস করেন, বয়সন্ধকালীন শারিরীক মানসিক পরিবর্তন নিয়ে পড়া উচিত নয়। কথা বলা উচিত নয়। মাসিক এবং স্বপ্নদোষের মতো স্বাভাবিক বায়োলোজির সায়েন্টেফিক স্টাডি দরকার নেই। কিশোরীদের পিরিয়ড বা মাসিকের সময় এবং কিশোরদের স্বপ্নদোষ বা ওয়েট ড্রিম হলে শরীর এবং মনের যে পরিবর্তন হয়, তার ব্যাপারে এওয়ারনেস, পরিচর্যা, এসব তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। যৌনতার মতো বাস্তব বিষয় এদের কাছে অশ্লীল। এরা মনে করেন তাদের বাচ্চারা সারাজীবন জানবে দুটো গোলাপ ফুল টোকাটুকি করলে আসমান থেকে টুপ করে বাচ্চা পড়ে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। আমার মেয়ের বয়স যখন নয় বছর হতেই আমি তাকে পিরিয়ড নিয়ে নিয়মিত ওরিয়েন্টেশন দিতাম। সঙ্গে তার বাবাকেও দিতাম। কারণ আমি দেশ বিদেশ ট্যুরে যাই। সেই সময় পিরিয়ড হয়ে গেলে বাপ যেন মেয়েকে সাপোর্ট করতে পারে। ছেলে একটু বড় হলে তাকেও মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে ওরিয়েন্ট করা শুরু করলাম এই নিয়তে যে, সে যেন তার কোনো সহপাঠির জামায় রক্ত দেখলে হাসাহাসি না করে, সহপাঠিকে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়। তো, একদিন তাদের পিতা ঘোষণা দিলেন, আমার সবকিছুই বেশি বেশি। পুত্র-কন্যাকে এসব কেন এতো ঘটা করে শেখাতে হবে? আমার কি পিরিয়ড হয়নি? আমি কি নিজে নিজে এসব শিখে ফেলিনি? আমি তাজ্জব হয়ে কিছুক্ষণ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি একজন জেন্ডার ট্রেইনার।

তারপর ঠান্ডা স্বরে উনাকে বললাম, ‘আমি প্রথম মাসিকের সময় যে প্রক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া এবং অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছি, তার জন্য আমার মাকে আমি জীবনেও মাফ করবো না’। এরপর ছেলে বড় হলো, সেও স্বাভাবিক নিয়মে বয়সন্ধীকালে পৌঁছালো। আমি এবার তার বাবাকেই বললাম, ‘দেখো, তোমার পুত্র হলেও তো সে সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। পুরুষ হিসেবে তারও কিছু শারীরিক পরিবর্তন হবে। তারও যৌনতার বোধ তৈরি হবে, তারও স্বপ্নদোষ হবে। সেও ভয় পাবে, লজ্জা পাবে এবং মিসগাইডেড হবে। তুমি তার সঙ্গে একটু সহজ হও, তাকে প্রস্তুত কর, তার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলো’। তিনি সাত আসমানের উপর থেকে পড়লেন। বললেন, ‘তোমার মাথা কি পুরা খারাপ হয়ে গেছে? এখন আমি বলে বসে ছেলেরে স্বপ্নদোষ শিখাবো? আমি ক্যামনে শিখসিলাম? সেও ওভাবেই শিখবে’। আমি মৌরী চাবাতে চাবাতে বললাম, ‘তুমি শিখেছো ক্যানভাসারের কাছ থেকে, তারপর বন্ধুদের নিয়ে ভিসিআর ভাড়া করে ব্লু ফিল্ম দেখে হাত মারতে মারতে। তোমার ছেলেও তাই করুক সেটাই চাও? আমি তো সেটা হতে দেবো না’। সে বললো, আমি নিজের হাতে বাচ্চা নষ্ট করছি এবং বলাই বাহুল্য ‘বাচ্চা নষ্ট করার’ মিশন হিসেবে আমিই মা এবং বাপ দুটোই হয়ে পুত্রকে এসব ‘বাজে’ বিষয় শিখিয়েছি।

তো, এই হইলো আমাদের প্রচলিত ‘আই অ্যাম অ্যা জিপিএ-৫’ শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে সেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ এডুকেশন পড়াতে শিক্ষকরাই লজ্জা পান, ছাত্রদের কথা আর কী বলবো? এখন আমি নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াই এজন্য যে, তিনটা বাচ্চার একটাকেও আমি এই বানরের তৈলাক্ত বাঁশের উঠানামার গ্যাঞ্জামে ফেলিনি। গায়ের রক্ত পানি করে এমন একটা কারিকুলামে তাদের পড়িয়েছি যেখানে তাদের উপপাদ্য মুখস্থ করতে হয়নি, কোচিং-সিলেবাস-সাজেশন এইসব শব্দের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটেনি। তারা শিখেছে প্রজেক্ট বেইজড স্টাডি, গ্রুপ এডুকেশন, এসাইনমেন্ট। তারা ডিম ভাজা তো শিখেছেই, পাশাপাশি এমন সব লাইফ স্কিলস এডুকেশন তারা পেয়েছে যে, এখান থেকে ফিক্কা মেরে ফেলে দিলেও তারা যে কোনো দেশে গিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে জায়গা করে নেবে এবং এইটাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশ এতো বছর পরে হলেও যে পোষ মানানো শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে মুক্তিকামী শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করেছে তা ঠিকঠাক মতো ডেলিভারি দিতে পারলে আখেরে একটা স্ব-শিক্ষিত জনগোষ্ঠি তৈরি হবে।

তবে সব এক্সপেরিমেন্টই কস্টলি, এটিও মাথায় রাখতে হবে। সেই কস্ট যেন বাচাদের মাথার উপর দিয়ে না যায় সেটা খুব নজর দিতে হবে। প্রচুর শিক্ষক তৈরি করতে হবে। সহজলভ্য উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনভেস্ট করতে হবে। তা না হলে ডিম ভাজাও নষ্ট হবে, বানরের বাঁশও ফেটে যাবে।

লেখক : সাদিয়া নাসরিন – সোশ্যাল মিডিয়া এক্টিভিস্ট 


সর্বশেষ - রাজনীতি