সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস সমাজে নতুন কিছু নয়। পৃথিবীব্যাপী মানুষের সক্ষমতা, সামাজিক অবস্থান এবং অন্যান্য সূচকের ভিত্তিতে সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। সমাজে একদিকে যেমন রয়েছে উচ্চবিত্ত, ঠিক অন্যদিকে রয়েছে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনাদিকাল থেকে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব দেখা গেছে। উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মাঝখানে সবচেয়ে নিষ্পেষিত শ্রেণি হচ্ছে মধ্যবিত্ত। কারণ, তাদের অবস্থান না উচ্চবিত্তের কাতারে, না নিম্নবিত্তের কাতারে। তারা একদিকে যেমন জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি পর্যায়ের নিচে আর নামতে পারে না, ঠিক তেমনি প্রয়োজনের তাগিদে উচ্চবিত্তের মতো অর্থ খরচ করতে পারে না। ফলে, বর্তমান বাস্তবতায় এই শ্রেণির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন কেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা বর্তমান লেখায় অবতারণা করা হয়েছে?
২০২০ সালের গোড়ার দিকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ অতিমারির প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। যখন কোভিড-১৯-এর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ঠিক সেই সময় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এই মন্দার প্রভাব ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। ইউরোপ ও আমেরিকার অবস্থাও খুব ভালো নয়। ইউরোপের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে চরমভাবে।
যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি অঙ্কে রয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা সামাল দিতে ইতোমধ্যে দুই জন প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাস মোটামুটি শক্ত অবস্থানে ছিল। কিন্তু সময় যতই অতিবাহিত হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটা কমে গেছে। আমদানি ব্যয় নির্বাহ করতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক বিলাস পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সবার মধ্যে যে উৎকণ্ঠাটি কাজ করছে সেটি হচ্ছে ২০২৩ সালে এই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের ওপর কেমন পড়তে যাচ্ছে?
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন।
বৈশ্বিক মন্দা পরবর্তী অর্থনৈতিক অচলাবস্থা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি এবং ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে, জনগণের চাহিদা মেটানোর জন্য সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হচ্ছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলেও কোনোভাবেই বাজারে দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পক্ষে। এই শ্রেণির মানুষ জীবনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে। মূলত এই শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষ বিভিন্ন বেসরকারি অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। এদের মধ্যে আবার একটি বড় অংশ তাদের অনেক কষ্টার্জিত সঞ্চয় দিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সেই মুনাফা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু মন্দার প্রভাব মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সরকার একদিকে যেমন সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়েছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন স্ল্যাবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাকে ভাগ করার ফলে সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমে গেছে। ফলে, আগের চেয়ে অনেকের আয় কমে গেছে।
করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়েই অনেক কর্মচারী ছাঁটাই করেছে। এরা মূলত সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, যাদের এক অংশের যেমন কাজ নেই, ঠিক তেমনি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল অংশের সঞ্চয়পত্র থেকে আয় কমে গেছে। ফলে জীবন নির্বাহ করা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, এই শ্রেণির মানুষের আবার আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রকট।
ফলে, তারা একটি পর্যায়ের নিচে কাজ করতে পারে না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তারা বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে।
এই পরিস্থিতিতে যে বিষয়টি সবার মধ্যে আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো, মধ্যবিত্ত শ্রেণি কি তাহলে সমাজ থেকে হারিয়ে যাবে? এর অর্থ এই নয় যে সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই শুধু কষ্টে আছে। সমাজের সব শ্রেণির মানুষই একটি খারাপ সময়ের মধ্যে দিনযাপন করছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবন অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে এই কারণে যে তারা একটি অবস্থার নিচে নিজেদের নিয়ে যেতে পারে না। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষ বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। তারা বাধ্য হচ্ছে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে যেকোনও ধরনের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে। এই অবস্থা চলতে থাকলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থানের ওপর।
বাজারে যেভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারের দু’বছর আগে মাসে যে খরচ হতো তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোভিড-১৯ অতিমারির সময়ে যে ময়দা বিক্রি হতো ৪০ টাকা কেজি, বর্তমান তা বেড়ে ৬২/৬৫ টাকা হয়েছে। একইভাবে চালের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সবজির বাজারে মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। মাছ ও মাংসের দামের ক্ষেত্রেও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, পরিবারের সদস্যদের প্রোটিনের চাহিদা মেটানো অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্রয়লার মুরগি বাংলাদেশের মানুষের প্রোটিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। দুই বছর আগেও ১ কেজি ব্রয়লার মুরগি দাম ছিল ১০০/১১০ টাকা। বর্তমানে ১ কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম হয়েছে ১৭০/১৯০ টাকা। ফলে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে পরিবারের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের শুধু সামাজিকভাবেই হেয় হতে হচ্ছে না, তারা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীনও হচ্ছে। প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে প্রোটিন গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু একটি বড় জনগোষ্ঠীর পক্ষে সুষম খাবার গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রোটিনের অভাবে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে একদিকে যেমন ২০২৩ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে বাংলাদেশের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি দেখা দেবার সম্ভাবনার কথা বলেছেন, ঠিক তেমনি এর প্রভাবে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে বলে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তিনি জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন নিজেদের আশপাশে এবং বিভিন্ন পরিত্যক্ত জমিতে শাকসবজির আবাদ করার, যাতে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা দেখা দিলে একটি পরিবার নিজেদের প্রয়োজন নিজেরা মেটাতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষের নিজেদের জমি নেই, যেখানে তারা শাকসবজির আবাদ করতে পারে। এই শ্রেণির বেশিরভাগ মানুষকে নির্ভর করতে হয় তাদের প্রত্যেক দিনের শ্রমের মূল্যের ওপরে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রম বিক্রির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের ওপর।
এই কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে স্বভাবতই সবার মধ্যে যে প্রশ্নটি আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো বাংলাদেশের মতো দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব কি তাহলে হুমকির সম্মুখীন? এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলতে থাকে তাহলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তে পরিণত হবে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সমাজের সব স্তরের, বিশেষ করে উচ্চবিত্তদের এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের মতো দেশে সরকারের পক্ষে বিপদের সময় জনগণকে বিপুল সহায়তা প্রদান করা সম্ভব নয়। তাছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা হলেও ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। তবে, আশার বিষয় আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা (আইএমএফ) এই মন্দাকালে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে।
এই সহায়তা সরকারকে অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে, কিন্তু দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। আর সেই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
লেখক: ড. প্রণব কুমার পান্ডে – অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।