1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

আসন্ন বৈশ্বিক খাদ্যসঙ্কটে বাংলাদেশের করণীয়

অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০২২
অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস

আমাদের সবার মনে থাকার কথা যে বাংলায় দুটি বিভীষিকাময় দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছিল—১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালে। দুটিই হয়েছিল মস্ত যুদ্ধের পটভূমিকায়। প্রথমটি উদ্ভূত হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আতঙ্কের মধ্য দিয়ে; আর দ্বিতীয়টি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ অনুসরণ করে এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফাঁদে। যা হোক, উভয় দুর্ভিক্ষের দুঃখজনিত বেদনার প্রতিচ্ছবি জাতির দুই প্রজন্মকে তাড়া করে। ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল, ক্ষুধার্ত মানুষের ধনীর দরজায় টোকা মেরে কদাচিৎ সাড়া পাওয়া; যুদ্ধের ময়দানে নয়, বরং আপাতদৃষ্টিতে শান্তিময় এবং নিষ্ক্রিয় জায়গায়, যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তার পাশে, খালি ধানি জমিতে কিংবা বাজারগুলোতে লাশ পড়ে থাকা ইত্যাদি। স্বভাবতই, এত দিন অতীতের প্রেতাত্মার ভয়ে তাড়িত হয়ে নীতিনির্ধারকরা সব সময় সরাসরি খাদ্য বিতরণ কিংবা শক্তভাবে খাদ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ এড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সফল হয়েছেন, যদিও নীরব দুর্ভিক্ষ অর্থাৎ পুষ্টিহীনতা কমবেশি বিদ্যমান।

২০০০ সালে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফ্রি) কর্তৃক প্রকাশিত হওয়া একটি বইয়ের নাম ‘Out of the shadow of famine : evolving food markets and food policy in Bangladesh’. বইটির সম্পাদনায় ছিলেন রইসুদ্দিন আহমেদ, স্তিফেন হেগব্লেড ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী (প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা)। বাংলাদেশ কিভাবে দুর্ভিক্ষের অপরিবর্তনীয় হুমকি থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য দেশের খাদ্য বাজার ও খাদ্য নীতিমালায় রূপান্তর ঘটাল, সেই বর্ণনা নিয়ে ৩০৭ পৃষ্ঠার বইটি রচিত হয়েছিল। মোটকথা, বিখ্যাত ওই বইটি বলতে চেয়েছে বাংলাদেশের ধানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, উপকরণ বাজার বেসরকারীকরণ ও উদারীকরণ নীতিমালা ইত্যাদি মিলিতভাবে একটি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাকে অনেক নিচে নামিয়ে এনেছে এবং বলা যায়, বাংলাদেশ এখন দুর্ভিক্ষের ছায়ার বাইরে।
১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা আবারও উঠেছিল কোনো কোনো মহল থেকে, কিন্তু তৎকালীন সরকারের যথোপযুক্ত হস্তক্ষেপে সেটি থেকে মুক্তি মিলেছিল এবং দুর্ভিক্ষ ছিল অনেক দূরে।

১৯৯৮ থেকে ২০২২ সাল—প্রায় আড়াই দশক পর দুর্ভিক্ষ শব্দটি আবার কানে এলো এবং তা-ও স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে। সম্প্রতি জাতিসংঘ সফর শেষে, বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণের আলোকে তিনি বলতে চেয়েছেন, ২০২৩ সালে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে, এমনকি দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারি, তিনি দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন, ‘তৈরি থাকুন, বাংলাদেশকে যেন কখনো দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করতে না হয়’; ‘আমাদের মাটি আর মানুষ আছে, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ পরিহারের জন্য আরো বেশি খাদ্য উৎপাদন করুন, অর্থ বাঁচান’।

বিষয়টি এখন স্পষ্টতর হয়ে উঠছে যে উঁচু মূল্যস্ফীতি এবং চরম জ্বালানিসংকটে বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে খাদ্য ঘাটতির সমস্যা হবে গোদের ওপর বিষফোড়া। এমনিতে কভিড-১৯ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সরবরাহ শিকল ব্যাহত করে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের পথ কুঞ্চিত করে রেখেছিল, তার ওপর চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ অর্থনৈতিক অবনতির সলতে হিসেবে কাজ করছে। ইউক্রেন বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অনেক দেশ এর উৎপাদিত গম খেয়ে বাঁচে বলে একে ব্রেডবাস্কেট হিসেবে অবহিত করা হয়। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কারণে অন্য দেশ থেকে চড়া দামে গম সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছে ভোক্তা দেশগুলো। এরই মধ্যে জলবায়ুজনিত পরিবর্তন খাদ্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং জলবায়ুর পরিবর্তন সাপেক্ষে ঘন ঘন খরা ও বন্যার পূর্বাভাস প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক যে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিশ্বের শস্য ও খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে ১.৪ শতাংশ।

অতীতের খাদ্যসংকটের সূত্র ধরে বলা যায়, ‘চাচা আপন পরান বাঁচা’ নীতিতে সংকটের সময় প্রতিটি দেশ তার সংরক্ষণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তির্যক করে তোলে। ২০০৮ সালের খাদ্যসংকটের সময় বিভিন্ন দেশে, বিশেষত প্রতিবেশী ভারতের কাছে চাল চেয়েও বাংলাদেশ পায়নি। বহুজাতিক বাণিজ্য-নিয়ম মুখ থুবড়ে পড়ে তখন।

গেল কয়েক দশকে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনে কৃতিত্বের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে আপাতত এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের এক কোটি টন থেকে বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থানে, যার প্রায় পুরো কৃতিত্ব ‘সবুজ বিপ্লবের’। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়া এবং মাথাপিছু আয়ের ঊর্ধ্বগামিতা খাদ্য ভোগ বৃদ্ধি এবং পুষ্টির উন্নতিতে ভূমিকা রাখছে; যেমন—খর্বতা কমেছে ২০১৩ সালের ৪২ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ২৮ শতাংশ। পুনরুক্তি যদিও, সরকারের ইতিবাচক নীতিমালা, কৃষকের জ্ঞানভিত্তিক আচরণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসের কারণে বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের ছায়ার বাইরে অবস্থান নিতে পেরেছে।

গ্রামের চলতি কথায় আছে, ‘সেই দিন নাইরে নাতি গাবুতগুবুত খাতি।’ এফএওর প্রক্ষেপণ বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। যে ৪৫টি দেশ খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হবে, বাংলাদেশ নাকি তার মধ্যে অন্যতম। সারা বিশ্ব যখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান নেবে, তখন বাংলাদেশের পক্ষে কি তা এড়ানো সম্ভব? যদিও অতিমারির সময় আমাদের কৃষকরা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা রোধে কী ব্যবস্থা কিভাবে নেওয়া যায়, সেটিই প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে।

প্রথমেই আসে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি। অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বঙ্গবন্ধুও বারবার বলতেন, এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও যেন পতিত না থাকে। তবে নীতিনির্ধারক মহলের সর্বদা স্মরণ রাখা দরকার যে খাদ্যের লভ্যতা দুর্ভিক্ষ রোধে একটি দরকারি শর্ত মাত্র, যথেষ্ট শর্ত নয়। খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার প্রচুর উদাহরণ আছে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের লেখায়। সুতরাং স্বত্বাধিকার (entitlement) আয়-উপার্জন বৃদ্ধি করে খাবার কেনার সুযোগ করে দিতে হবে। এই লক্ষ্যে শ্রমনিবিড় ক্ষুদ্রশিল্প ও কৃষি এবং সেবা খাতে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

দুই. উৎপাদন বৃদ্ধির প্রসঙ্গে কৃষিতে ভর্তুকির কথা উঠে আসে। এমনিতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথাগত কৃষি এবং কৃষকবান্ধব নীতিমালা সর্বজনস্বীকৃত, তার পরও বলতে হয় উৎপাদনের উপকরণের, বিশেষত ডিজেলের এবং রাসায়নিক সারের চলমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের প্রয়োজনকে প্রকট করে তুলেছে। প্রসঙ্গত, অভিযোগ আছে যে নানা জটিলতার জন্য প্যান্ডেমিকের সময় প্রত্যেক কৃষককে প্রদত্ত পাঁচ হাজার টাকা ভর্তুকি অনেক কৃষক পাননি; সুতরাং নিশ্চিত করতে হবে যে যার দরকার সে-ই যেন ভর্তুকি পায়।

তিন. যেহেতু উৎপাদন খরচ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই কৃষক যেন উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান (মোট উৎপাদনের অর্থনৈতিক ব্যয় যোগ ১০ থেকে ২০ শতাংশ মার্জিন), তা নিশ্চিত করতে হবে। মোটকথা, যথাসময়ে, যথোপযুক্ত দামে, উপকরণ ও উৎপাদনের দামে কৃষক যেন উৎসাহিত বোধ করেন।

চার. একরপ্রতি খাদ্য উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করতে নবধারামূলক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বিগত দিনে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দেশকে দুর্ভিক্ষ এড়াতে সাহায্য করেছে, কিন্তু ২০২৩ সালে কিংবা তার পর যে দুর্ভিক্ষের আলামতের কথা শোনা যাচ্ছে, সেই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় অধিকতর উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন বিধায় কৃষি গবেষণায় অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দরকার।

পাঁচ. এ কথা সত্যি যে শস্য সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ, গুদামে ধারণ ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় যথাযথ নীতিমালা এবং শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার। যেমন দরকার এসব স্তরে আমূল সংস্কার। দুর্ভিক্ষ এড়াতে শুধু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়; খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং বিতরণের প্রতি ধাপে প্রথাগত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ছয়. অতীতে বেসরকারি খাতে খাদ্য আমদানি তীব্র খাদ্যসংকট থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। সামনের কঠিন দিনগুলোতে সরকারি-বেসরকারি আমদানি অব্যাহত থাকতে হবে। সংকটের সুযোগে যেন বাজার অস্থিতিশীল না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

সব শেষে খাদ্যঝুঁকিতে নিপতিত দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের জনগণের জন্য খোলাবাজারে বিক্রি, নগদ অর্থ কিংবা অন্যান্য উপায় উদ্ভাবন করে; যেমন—গণখাতে শ্রমবহুল উন্নয়ন প্রকল্প, স্বত্বাধিকার বা ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর সুব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশের কৃষকের রিজিলিয়েন্স, সরকার কর্তৃক গৃহীত কৃষিবান্ধব নীতিমালা, অব্যাহত কৃষি গবেষণা এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষ থেকে দূরে রাখবে বলে মনে করি। দুর্ভিক্ষের সংবাদে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। যা প্রয়োজন তা হলো অতীতের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নবধারামূলক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ ‘Out of the shadow of famine’ ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

লেখক : অধ্যাপক ড. আব্দুল বায়েস – সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ - রাজনীতি