1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

একাত্তরের গণহত্যা ও মার্কিন সরকারের বোধোদয়

এ কে এম আতিকুর রহমান : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২২

কিছুদিন আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক পার্টির এক রিসেপশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পাকিস্তানকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে একটি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। কোনো সমন্বয় ছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করার পরিপ্রেক্ষিতে যদিও তিনি কথাটি বলেছেন, হয়তো ওই বক্তব্যের অভ্যন্তরে আরো অনেক অজানা সত্য লুকানো আছে। বাইডেন সাহেব দয়া করে যদি পাকিস্তানের অতীত ইতিহাস একটু গভীরভাবে ঘেঁটে দেখতেন, তাহলে বুঝতে সক্ষম হতেন যে পাকিস্তানকে চিনতে অনেকটাই দেরি করে ফেলেছিলেন তাঁর পূর্বসূরিরা। অবাক লাগে যে পাকিস্তানকে চিনতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহাশক্তিশালী একটি দেশকে ৫০ বছরেরও বেশি অপেক্ষা করতে হলো।

অথচ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ বিপজ্জনক পাকিস্তানকে স্পষ্টভাবে চিনতে পেরেছিল ১৯৭১ সালে। যাই হোক, এত বছর পরে হলেও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যে পাকিস্তানের আসল চেহারা দেখতে পেয়েছে, সেটিই অনেক বড় কথা। তবে সামান্য হলেও মনের ভেতর যে সন্দেহ রয়েই যায়, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই পাকিস্তানকে ওই রকম দেশ মনে করে, নাকি এ কথার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে?

তথ্য মতে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন সেদিন বিদ্যমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে চীন ও রাশিয়া সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার সময় পাকিস্তানের ওপর ওই মন্তব্য করেন। চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চীন ও রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও পাকিস্তানের একই উচ্চতার সম্পর্ক ছিল। তবে ২০১০ সালের পরে রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক যেভাবে গভীর হতে থাকে তাতে মার্কিন নেতৃত্বে পাকিস্তানকে নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। অনেকের মতে, তার ফলে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পদত্যাগ করতে হয়। তাই চীনকে ভর করে রাশিয়ার সঙ্গে আবার কোনো চোরাগলিতে পাকিস্তান পা বাড়ায় কি না সেই সন্দেহ থাকাটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, পাকিস্তানের বর্তমান সরকার ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে এরই মধ্যে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পাকিস্তানকে এভাবে ‘চিহ্নিত’ করার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য কী হতে পারে? পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে ওঠা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং গত এক দশকে সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটা নিয়ে আমরা যদি একটু চিন্তা করি, তাহলে যে সম্ভাব্য চিত্র দেখতে পাই—ক. পাকিস্তান আসলেই একটি বিপজ্জনক দেশ, যা এত দিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝে থাকলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিপত্তি সংরক্ষণের স্বার্থে বলেনি; খ. গত বছর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান তালেবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসায় পাকিস্তানের ভূখণ্ডে তালেবানদের ‘ফ্রি স্টাইল মুভমেন্ট’ তাদের পারমাণবিক অস্ত্র হস্তগত করার প্রতি উৎসাহী করে তুলতে পারে; গ. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন সমীকরণ বিদ্যমান পাকিস্তান-চীন সম্পর্কের জেরে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলার আশঙ্কা এবং ঘ. পাকিস্তান যেন চলমান ‘রাশিয়া ও চীন সমীকরণ’-এর বেড়াজালে না পড়ে যায় তাই এক ধরনের চাপের মধ্যে রাখা। যদিও ইমরান সরকারের পতনের পর পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

তালেবানের জন্ম হওয়া এবং বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের মাটিতেই। আর জন্মলগ্ন থেকেই তালেবানদের পাশে সব ধরনের সাহায্য এবং সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন সরকার। পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পর তালেবানদের ওপর থেকে মার্কিন আশীর্বাদ উধাও হয়ে যায়। আবার সেই যুক্তরাষ্ট্রই গত বছর তালেবানদের হাতে আফগানিস্তানকে সমর্পণ করে চলে আসে। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবান সরকারের দহরম-মহরমের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সে রকম লক্ষণ এরই মধ্যে পাকিস্তানের কয়েকটি অঞ্চলে প্রকট হয়ে উঠেছে। তথ্য মতে, পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকাসহ খাইবারপাখতুনখোয়া (পূর্বের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত) প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটির নিরাপত্তাব্যবস্থা হুমকিতে পড়েছে। এদিকে পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে দুর্বলতা ধরে জঙ্গিবাদের বড় ধরনের উত্থান দেশটিকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তালেবানদের কর্মকাণ্ডের ভয়াবহতা এবং পাকিস্তান ভূখণ্ডে তাদের অবাধ বিচরণ মার্কিন সরকারের জানা আছে বলেই পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষা নিয়ে তাদের এই উদ্বেগ আর অস্থিরতা।

আমরা জানি, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা সমীকরণ কাজ করে। সেসবের হিসাব-নিকাশ যে শুধু বড় দেশগুলোই করে থাকে তেমনটি নয়। মাঝারি এবং ছোট দেশগুলোকেও ওই সব সমীকরণ প্রত্যক্ষ এবং বিবেচনা করে চলতে হয়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে যেসব থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন পাকিস্তানের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা অযৌক্তিক মনে হবে না। পারমাণবিক অস্ত্র তো দূরের কথা, কোনো ধরনের অস্ত্রই যে পাকিস্তানের হাতে নিরাপদ নয় তা প্রমাণের জন্য খুব একটা বেগ পাওয়ার কথা নয়। তবে পূর্বের সেসব ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারকে এমনভাবে উৎকণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করেছিল তাতে সারা বিশ্ব সোচ্চার হলেও মার্কিন সরকারের কোনো উদ্বেগই দেখা যায়নি। বরং ওই হত্যাযজ্ঞে তারা পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতা করা ছাড়াও নানাভাবে মদদ জুগিয়ে গেছে, যদিও আমেরিকার জনগণ সেদিন তাদের সরকারের নীতির বিরোধিতা করেছিল। ভাগ্যিস ওই সময় পাকিস্তানের হাতে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না, থাকলে হয়তো এই বাংলাদেশে কোনো মানুষ থাকা তো দূরের কথা, সবুজ গাছপালাও কোনো দিন জন্মাতো কি না সন্দেহ। সেই বিবেচনায় যদি বাইডেন সরকার পাকিস্তানকে নিয়ে এ ধরনের আশঙ্কার কথা মন থেকে বলে থাকে তা শুধু আমেরিকার সাধারণ মানুষকেই স্বস্তি দেবে না, হয়তো বিশ্বের অন্যান্য দেশের জনগণকেও আশ্বস্ত করবে।

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে চালানো গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে। প্রস্তাবটিতে বাংলাদেশে সংঘটিত ওই গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিও তোলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ওই প্রস্তাবটি এনেছেন রিপাবলিকান দলের দুই আইনপ্রণেতা রো খান্না এবং স্টিভ চ্যাবট। রিপাবলিকান দলের আনা এই প্রস্তাবে মি. বাইডেন কী ভূমিকা গ্রহণ করেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।

এই মুহূর্তে আমাদের মনে পড়ে যায় মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির কথা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালিদের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করার ওপর ভিত্তি করে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন ১৭ আগস্ট ১৯৭১ সালে ‘আফটার ভিজিটিং রিফিউজি ইন ইন্ডিয়া কেনেডি হিটস পাকিস্তান জেনোসাইড’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে মি. কেনেডি পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে অভিযুক্ত না করে উপায় নেই বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। একই তারিখে সে দেশের আরো কয়েকটি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যাকে নিয়ে একই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু সেদিন মার্কিন সরকার পাকিস্তানকেই সমর্থন করে গেছে, এমনকি বাঙালি নিধনে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। পাকিস্তান যে কি ভয়াবহ তা বুঝতে পারলেও ক্ষমতার দম্ভ তাদেরকে অন্ধ করে রেখেছিল।

আমরা জানি, ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সিনেটর কেনেডি বাংলাদেশ সফরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক ছাত্র-জনতার সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘যদিও মার্কিন সরকার আপনাদের সঙ্গে ছিল না, তবু আমেরিকার জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তা করেছিল। ’ এমনকি তারা আমেরিকার সিনেটে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য প্রস্তাবও এনেছিল। যাই হোক, বাংলাদেশকে আমেরিকা স্বীকৃতি প্রদান করে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে। তবে সিনেটর কেনেডির পর পাকিস্তান বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে এই প্রস্তাবটি আনা এত বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন জনগণের ওই সময়ের অনুভূতিকেই জাগ্রত করে। এ উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের আবেগকেও প্লাবিত করে।

হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে যদি প্রস্তাবটি পাস হয়, তাহলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন সরকারের নীতি যে ভুল ছিল তা-ই শুধু প্রমাণিত হবে না, পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন এবং সামরিক সহযোগিতা করে যে তারা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংঘটিত গণহত্যায় নিজেদেরও সম্পৃক্ত করেছিল, সেই অপরাধ বোধের প্রায়শ্চিত্ত করার একটি সুযোগ আসবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তা আরো বেগবান ও শক্তিশালী হবে। আমাদের প্রত্যাশা, আমেরিকার জনগণ ৫১ বছর আগের করা তাদের সরকারের সেই ভুলকে শুধরে নেওয়ার এ সুযোগটি নিশ্চয়ই হারাবে না। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংঘটিত সেই গণহত্যায় নৃশংসভাবে নিহত হওয়া বাঙালি পরিবারগুলোর পাশে আবার দাঁড়াবে, যেমনটি তারা করেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে।

লেখক : এ কে এম আতিকুর রহমান – সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব।


সর্বশেষ - রাজনীতি