1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বাঙালি গণহত্যা ও বিশ্ব মোড়লদের ভুল সংশোধনের সুযোগ

হারুন হাবীব : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২২

একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা বিংশ শতাব্দীর বৃহৎ ও নৃশংস গণহত্যাগুলোর একটি। এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় অনুচরদের নির্বিচার নৃশংসতা ঘটেনি। বাঙালির ন্যায্য অধিকার হরণ করতে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরতম অভিযান থেকে জীবন বাঁচাতে এক কোটি ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং সেখানেই সংগঠিত, প্রশিক্ষিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী। এসব কোনো কল্পকাহিনি নয়; বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা লাভের অমোচনীয় রক্তরঞ্জিত ইতিহাস। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, যা কিনা আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ডে গণহত্যা বলে স্বীকৃত, তাকে জাতিসংঘ আজও স্বীকৃতি দেয়নি।

বাংলাদেশের মাটিতে ১৯৭১ সালের ৯ মাসে যে বর্বর গণহত্যা ও নির্বিচার ধর্ষণ ঘটেছিল, সেটাকে বিশ্বমোড়লদের এ যাবৎ এড়িয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছিল আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধকালে। যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড নিক্সন সরকার নিপীড়ক পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। যদিও আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়ার মানবতাকামী মানুষ ও সংবাদমাধ্যম ওই গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয়ত, গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে কৌশলগত কারণে ওয়াশিংটন চিরায়ত বন্ধু পাকিস্তানকে বিব্রত করতে চায়নি।

হালে পরিস্থিতির কিছুটা হেরফের হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে গত বছর গণহত্যা সম্পর্কিত খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট’ প্রথমবারের মতো বাঙালি গণহত্যার বিচারের দাবি তুলেছে। জাতিসংঘকে এই গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছে। এরপর এগিয়ে এসেছে গণহত্যা অধ্যয়ন ও নিরোধে নন্দিত বিশ্ব প্রতিষ্ঠান ‘জেনোসাইড ওয়াচ’।

চলতি অক্টোবরের ৩ তারিখে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে জেনেভায়। ইউরোপে অবস্থিত বাংলাদেশিদের দুটি সংগঠন প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদরদপ্তরে আয়োজন করে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা। তাতে বাঙালি গণহত্যা স্বীকৃতির দাবি তোলা হয়। সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সুখবর হচ্ছে- ‘হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’ বা মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে গত ১৫ অক্টোবর বাঙালি গণহত্যার বিশ্বস্বীকৃতির দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রথমবারের মতো প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। এমনকি সেই প্রস্তাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এই নির্বিচার গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এটি নিশ্চয় আরেক দফা অগ্রগতি।

আমেরিকার দুই প্রভাবশালী আইনপ্রণেতা প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন। তাঁদের একজন কংগ্রেসম্যান রো খান্না, অপরজন স্টিভ চ্যাবট। রিপাবলিকান দলের সদস্য স্টিভ চ্যাবট টুইট করেছেন- ‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার ঘটনা ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। ওহিও অঙ্গরাজ্যের সহকর্মীদের সহযোগিতায় আমরা বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর চালানো নৃশংসতা, বিশেষ করে যার কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’ পরের টুইটে তিনি আরও লেখেন- ‘গণহত্যার শিকার লাখো মানুষের স্মৃতিকে আমাদের বছরের পর বছর ধরে মুছে যেতে দেওয়া উচিত নয়। এ গণহত্যার স্বীকৃতি ঐতিহাসিক রেকর্ডকে সমৃদ্ধ করবে। এটি দেশবাসীকে শিক্ষিত করবে। সঙ্গে অপরাধীদের এই বার্তা দেবে- এ ধরনের অপরাধ সহ্য করা হবে না, কিংবা কেউ ভুলে যাবে না।’

ডেমোক্র্যাট নেতা রো খান্না টুইট করেছেন- ‘১৯৭১ সালে বাঙালি গণহত্যার স্মরণে প্রথম প্রস্তাব তোলেন স্টিভ চ্যাবট। সে প্রস্তাবে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিস্মৃত এক গণহত্যার শিকার জাতিগত লাখো বাঙালি এবং হিন্দু নিহত হয়েছেন কিংবা বাস্তুচ্যুত হন। গণহত্যার শিকার লাখো মানুষের স্মৃতিকে মুছে যেতে দেওয়া ঠিক নয়। এ গণহত্যার স্বীকৃতি অপরাধীদের এই বার্তা দেবে- এ ধরনের অপরাধ সহ্য করা হবে না কিংবা কেউ ভুলে যাবে না।’

বাংলাদেশ বা বাঙালির জন্য একাত্তরের ট্র্যাজেডি ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের বিশ্ববাসীর কাছে ১৯৭১ ক্রমান্বয়ে ধূসর হয়েছে। প্রভাবশালী দেশগুলো স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলেও তাদের প্রভাবিত বিশ্ব সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত বাঙালি গণহত্যাকে এড়িয়ে যাওয়ায় ধূসরতা আরও বেড়েছে।

গণহত্যার মতো ঘৃণিত মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বীকৃতি চাওয়ার মধ্যে কোনো প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ কামনা নেই। বরং আছে অপরাধের সুবিচার দাবি এবং গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধের নিশ্চয়তা বিধানের আহ্বান। আমরা যাঁরা একাত্তরের প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী তাঁরা জানি, কী সীমাহীন নৃশংসতা ও বর্বরতায় নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে! কী বর্বরতায় লাখো বাঙালি নারীকে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে! কিন্তু মানব সভ্যতার দুর্ভাগ্য, সেই ঘাতক বাহিনী নির্বিঘ্নে নিজ দেশে ফিরে গেছে! যদিও বলেছিল- অপরাধীদের বিচার করবে; পাকিস্তান সে প্রতিশ্রুতি রাখেনি। এমনকি বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে যে ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করে বিচারের দাবি তুলেছিল; তাদেরও বিচার হয়নি! শুধু তাই নয়, আজও পাকিস্তান একাত্তরের গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেনি। অথচ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এ রকম অপরাধের কারণে জাপান প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে চীন ও কোরিয়ার কাছে; নেদারল্যান্ডস ক্ষমা চেয়েছে ইন্দোনেশিয়ার কাছে।

অতএব বলতেই হবে, আমেরিকার সামনে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর নতুন পরীক্ষা এসেছে। তাদের পার্লামেন্টে তাদেরই গণপ্রতিনিধিরা প্রস্তাবটি পেশ করেছেন। বিশ্বমোড়লকে আজ বেছে নিতে হবে- তারা কি দীর্ঘ লালিত নৈতিক অপরাধের অংশীদার হতে থাকবে; নাকি ঐতিহাসিক বিকৃতির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সত্য ও ন্যায়বিচারকে গ্রহণ করবে।

১৯৪৮ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ এবং সাধারণ পরিষদের ২৬০ নম্বর রেজুলেশনে গণহত্যার সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে। তারই স্বীকৃতিতে ২০১৫ সাল থেকে ৯ ডিসেম্বর ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করা হয়। এরই মধ্যে জাতিসংঘ বেশ কয়েকটি বহুল আলোচিত গণহত্যার স্বীকৃতিও দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- আর্মেনীয় গণহত্যা, রুয়ান্ডায় তুটসি গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি গণহত্যা এবং হাল আমলের বসনিয়া ও কম্বোডিয়ার গণহত্যা। কিন্তু সংখ্যা ও সময় বিবেচনায় সবচেয়ে বড় ও নৃশংস যে গণহত্যাটি বাংলাদেশে ঘটেছে, তার স্বীকৃতি আসেনি জাতিসংঘ থেকে।

অথচ এই নির্বিচার বর্বরতায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যা বিশ্বজোড়া সংবাদমাধ্যম, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, প্রমাণ্যচিত্র, গ্রন্থ ও গবেষণায় স্বীকৃত। ৩ জুন ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ইউ থান্ট এক চিঠিতে মন্তব্য করেন- The happenings in East Pakistan constitute one of the most tragic episodes in human history. Of course, it is for future historians to gather facts and make their own evaluations, but it has been a very terrible blot on a page of human history.

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয় ২০১৭ সালের ১১ মার্চ। এখন এই ভয়াবহ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সক্রিয় হতে হবে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে গণহত্যার বিবরণ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সারাদেশে গণহত্যার নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। অন্যদিকে ১৯৫ পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আগে পাকিস্তান সরকার এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সংক্রান্ত যেসব বিবৃতি দিয়েছে, তা ব্যবহার করতে হবে। আত্মরক্ষামূলক নয়; বরং ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সরব ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান জোরদার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারি যেমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে; পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা যেমন স্বীকৃতি পেয়েছে; তেমনি স্বীকৃতি আনতে হবে ১৯৭১-এর গণহত্যার।

লেখক : হারুন হাবীব – বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। hh1971@gmail.com


সর্বশেষ - রাজনীতি