1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

আসছে মন্দার বছর, মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই

নিরঞ্জন রায় : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২২

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে আগামী বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সবচেয়ে খারাপ আকার ধারণ করবে। তিনি এই মন্দা মোকাবেলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন এবং এই লক্ষ্যে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির আহবান জানিয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার কথা প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি নিজে যেমন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং দেশবাসীকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা যেখানে কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারেন না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী পেশাজীবী না হয়েও একজন সরকারপ্রধান হিসেবে তা খুব সহজেই আঁচ করতে পারেন। পেশাজীবী ও পরিবেশবিদদের তীব্র বিরোধিতা এবং আন্দোলনকে কোনো রকম আমলে না নিয়ে তিনি একক সিদ্ধান্তে বাগেরহাটের রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এগিয়ে নিয়েছেন। কারণ তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য শুধু গ্যাস বা জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভর করা হবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ এবং এ কারণেই তিনি কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালিয়ে নিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের সময় তাঁর সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। ঠিক একইভাবে বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে বুঝেই উঠতে পারছে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছেন যে আগামী বছর হবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে খারাপ সময়।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা যে আগামী বছর মারাত্মক হতে পারে তেমন আশঙ্কা শুধু প্রধানমন্ত্রী যে একা করেছেন তেমন নয়, বিশ্বের অনেক নামিদামি অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক খাতের বিশ্লেষকও একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে আসছেন অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এই মন্দার বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়া এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে সেভাবে আলোচনাই হয় না। কিছু মিডিয়ায় শুধু উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কথাই প্রচার করা হয়। এবারের অর্থনৈতিক মন্দার পেছনে আছে রাজনৈতিক কারণ। ফলে এবারের মন্দার ধরন একটু ভিন্ন। সাধারণত তিনটি খাতের অধোগতি দিয়ে এখানকার অর্থনৈতিক মন্দা বিচার করা হয়ে থাকে। প্রথমত, উচ্চ বেকারত্বের হার। দ্বিতীয়ত, বাড়ির মূল্যের অস্বাভাবিক দরপতন এবং শেয়ার মার্কেটে ধস। এক রহস্যজনক কারণে এই তিনটি খাতে এখনো সেভাবে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এখনো সেভাবে চাকরিচ্যুতি শুরু হয়নি, যদিও ফেসবুক এবং গুগলসহ অনেক বড় কম্পানি কর্মী ছাঁটাই করার ঘোষণা দিয়েছে, যা আগামী বছর সবচেয়ে খারাপ আকার ধারণ করতে পারে। ক্রমাগত সুদের হার বৃদ্ধির কারণে বাড়ির মূল্যে কিছুটা স্থিতি অবস্থা বিরাজ করলেও সেভাবে দরপতনের ঘটনা এখনো ঘটেনি। বাড়ির মূল্যে ধস না নামলেও সেই অবস্থাও যে আগামী বছর নাগাদ সৃষ্টি হতে পারে, তা বেশ আঁচ করা যায়। কারণ একদিকে চাকরিচ্যুতির ঘটনা এবং অন্যদিকে উচ্চ সুদের হারের কারণে অনেকের মর্টগেজ বা ব্যাংকঋণ নবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে এর সমষ্টিগত প্রভাবে বাড়ির মূল্যে বড় ধরনের দরপতন হওয়াই স্বাভাবিক। আর স্টক মার্কেটের কথা আলোচনা না করাই ভালো। কেননা এখন শেয়ার ইনডেক্স আর অর্থনীতির উত্থান-পতনের ব্যারোমিটার হিসেবে কাজ করে না। এই মার্কেট যে কখন, কিভাবে ওঠানামা করে তা কোনো বিশ্লেষণেই ধরা পড়ে না। যখন মার্কেট বাড়ার কথা তখন কমে, আবার যখন কমার কথা তখন বাড়ে। যেমন—করোনা মহামারির সময় বিশ্ব যখন প্রায় থমকে ছিল তখন পশ্চিমা বিশ্বের স্টক মার্কেট প্রথমে কিছুটা কমে পরে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আবার বর্তমানে চতুর্দিকে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে সব কম্পানিই তাদের ভবিষ্যৎ লভ্যাংশ হ্রাস করেছে। এমন পরিস্থিতিতে স্টক মার্কেটে স্বাভাবিক নিয়মে দরপতন হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কখনো শেয়ারবাজার অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী, আবার কখনো নিম্নমুখী। আসলে শেয়ারবাজার এখন কিছু ফান্ড ম্যানেজার, হেজ ফান্ড এবং বিশ্বের ১ শতাংশ অতি ধনাঢ্য ব্যক্তির দখলে। তাই এখানে আর শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক নিয়ম কাজ করে না। ফলে স্টক মার্কেটের গতিবিধিকে এখন আর অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের ব্যারোমিটার হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। তার পরও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের মতে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির নেতিবাচক প্রভাব, হাউজিং মার্কেটের দরপতন এবং চাকরিচ্যুতির প্রভাবে আগামী বছর স্টক মার্কেটে দরপতন হতে বাধ্য। অর্থনীতির এসব মৌলিক বিষয় বিবেচনা করলে আগামী বছর আসলেই ভয়ংকর অর্থনৈতিক মন্দার বছর হবে বলেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। একই আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন বিশিষ্টজনরা।

যদিও এই অর্থনৈতিক মন্দার কেন্দ্রবিন্দু হবে পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু এর প্রভাব পড়বে সমগ্র বিশ্বে, যা থেকে আমাদের দেশও বাদ যাবে না। এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশের অর্থনীতির কাঠামো এবং মৌলিক ভিত্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ কারণেই এই মন্দার প্রভাব সেভাবে হয়তো দেখা যাবে না। তবে কিছু খাত মারাত্মক ধাক্কা খেতে পারে। যেমন—আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য, যা মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর। অথচ পশ্চিমা বিশ্বে মন্দা দেখা দিলে মানুষ প্রথমেই পোশাক ক্রয় কমিয়ে দেয়। ফলে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা কম অর্ডার পাবেন এবং এর ফলে তাঁদেরও চাকরিচ্যুতির মতো সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। এমনটা ঘটলে একদিকে দেশে বেকারত্ব আরো বেড়ে যাবে, অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে। এ অবস্থা মোকাবেলায় এখনই রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে অপ্রচলিত দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি ত্বরান্বিত করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে বিদেশে অপ্রচলিত দ্রব্যের রপ্তানির সুযোগ অবারিত হয়েছে। যেমন—পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ, প্যাকেজিং বক্স, প্লাস্টিক কনটেইনার, বিভিন্ন ধরনের বেকারি আইটেম, আমসহ কিছু ফলমূল, যেগুলো এখন তাইওয়ান ও ভিয়েতনাম থেকে আসছে, বিভিন্ন ধরনের মসলাসহ আরো অনেক আইটেম খুব সহজেই রপ্তানি করা সম্ভব। এখানে বলে রাখা ভালো, এর অনেক কিছুই আমাদের দেশ থেকে এসব দেশে আসছে, কিন্তু খুবই সীমিত আকারে প্রধানত বাংলাদেশি কমিউনিটির চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এখানকার মূলধারার জনগণের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এসব পণ্যের রপ্তানি বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ জন্য একদিকে যেমন স্বল্প পরিমাণের রপ্তানি বিধি শিথিল ও আধুনিক করতে হবে, অন্যদিকে তেমনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের রপ্তানি কাজে নিয়োজিত করতে হবে। উল্লেখ্য, আমাদের প্রতিবেশী দেশ থেকে ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকরা এভাবেই প্রচলিত পণ্য রপ্তানি করে আসছেন।

একইভাবে আমদানি ব্যয় হ্রাস করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে কার্যকরভাবে। আমদানি ব্যয় যাতে অকারণে বৃদ্ধি না পায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন—আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উন্নত বিশ্বের ব্যাংকের সঙ্গে সেভাবে করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ না থাকায় আমাদের দেশের আমদানিকারকদের পণ্য আমদানি করতে হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। যে কারণে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। অথচ অধিকসংখ্যক ব্যাংকের সঙ্গে করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ এবং কাউন্টারপার্টি লিমিট রাখার মাধ্যমে আমদানি ব্যয় যথেষ্ট সাশ্রয় হতে পারে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রায় সাশ্রয় হবে এবং সেই সঙ্গে দেশে দ্রব্যমূল্য কিছুটা হলেও কম হবে। একইভাবে অধিকসংখ্যক ব্যাংকের সঙ্গে করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ না থাকায় প্রবাসীরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণে সমস্যার সম্মুখীন হন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা মানি ট্রান্সফার এজেন্সির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করে থাকেন, আর এই এজেন্সির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ করলে উল্লেখযোগ্য অংশ হুন্ডির মাধ্যমে স্থানান্তর হয়। ফলে দেশ বঞ্চিত হয় বৈদেশিক মুদ্রা থেকে। আমরা যতই সমালোচনা করি না কেন, নানা কারণে এই হুন্ডি এক বাস্তবতা। এটি বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে অধিকসংখ্যক ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ স্থাপন করে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণ সহজ ও অবারিত করা। এ কথা ঠিক যে বর্তমান কঠোর কমপ্লায়েন্সের কারণে বিশ্বের অনেক বৃহৎ ব্যাংকের সঙ্গে চাইলেই এই করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ স্থাপন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই বিভিন্ন ছোট এবং মধ্যম মানের ব্যাংকের সঙ্গে করেসপনডেন্ট রিলেশনশিপ স্থাপনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটি কিভাবে সম্ভব তা তুলে ধরতে গেলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে নেই। একইভাবে বিদেশি ঋণ গ্রহণে, বিশেষ করে ডলারে ঋণ গ্রহণ থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। এর পাশাপাশি দেশের মানুষকে ব্যয় সাশ্রয় করে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সুদের হার বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ব্যাংক রেট বৃদ্ধি শুরু করেছে, কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে আমাদের দেশে ব্যাংক রেট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার সেভাবে বৃদ্ধি পায় না। তাই প্রয়োজনে সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে হলেও এই উদ্যোগ নিতে হবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে আগামী বছর হবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সবচেয়ে খারাপ সময়। আর আমাদের দেশে এই মন্দার প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন, যেমন—দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি, দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ী হওয়া এবং রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া। মূলত এসবই মন্দা মোকাবেলার জন্য এই মুহূর্তে সর্বোত্কৃষ্ট পদক্ষেপ এবং সে কারণেই এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে এখন থেকেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তারা যত দ্রুত এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ততই আগামী বছরের আশঙ্কার মন্দা মোকাবেলার কাজটি অনেক সহজ হবে।

লেখক : নিরঞ্জন রায় – সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা।

 


সর্বশেষ - রাজনীতি