বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। জাতীয় অর্থনীতিতে একটা বিরাট অংশ আসে এই কৃষি খাত থেকে। নতুন নতুন জাত উব্দোধন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে বেড়েছে ফলন কমেছে খাদ্য ঘাটতি। এখন দেশের চাহিদা পুরণ করেও বেশি মাত্রায় উৎপাদন। সকল ফসলের বিশ্বের প্রথম ১০ দেশের মধ্যে অবস্থান এখন বাংলাদেশের।
উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবার ক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক কৃষিকে আরো এগিয়ে নিতে দরকার অল্প জমিতে বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনের গবেষণা, কৃষির সমস্যাদি সমাধান, লাগসই ও টেকসই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগানো কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য এখন রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
বিশ্ব অর্থনীতির পরিসংখ্যানে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অনন্য উদাহরণ। ধান,সবজি, আলু ও ভুট্টাসহ খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, চাল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। শুধু তাই নয়, সবজিতে ৩য় ও আলুতে ৭ম অবস্থানে পৌছাতে সক্ষম হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে ৩০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বর্তমানে ফসলের নিবিড়তা ১৯৪%। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কৃষি যেভাবে অগ্রসারমান তাতে আগামীতে আরো উন্নীত হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কৃষি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে শুধুমাত্র চাল উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৮৬লাখ ৩৪হাজার মেট্রিক টন। ধান, গম. ভুট্রাসহ মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম।
দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলার কৃষি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কৃষি প্রধান বাংলাদেশের মাটি অধিক উর্বর এবং বিরাট সম্ভাবনার। কৃষিসমৃদ্ধ আবহাওয়া ও জলবায়ুর এত সুন্দর দেশ বিশ্বে খুব কমই আছে। বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় ৫ কোটি ৫০লাখ মেট্রিক টন। সুত্রানুযায়ী বিশ্বে খাদ্যশস্য উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। সেখানে উৎপাদন হয় ৫৫ কোটি ১১লাখ মেট্রিক টন। ৪৩ কোটি ৬৫লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ২য় অবস্থানে। ভারতের অবস্থান ৩য়। উৎপাদন হয় ২৯ কোটি ৩৯লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষির বিস্ময়কর উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিঃসন্দেহে বিরাট অর্জন।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। বিশেষ করে একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষে বিশ্বের মধ্যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। কৃষিজমির বিপরীতমুখী চাপ সত্ত্তেও বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে কৃষিই হচ্ছে প্রধান সহায়ক। সে কারণে জরুরিভাবে কৃষিকে আরো এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে যেসব প্রতিবন্ধকতা তা দুর করতে হবে। একইসঙ্গে অল্পজমিতে বেশি শস্য উৎপাদনের গবেষণা, কৃষির সমস্যাদি সমাধান, লাগসই ও টেকসই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগানো, সমন্বিত কৃষি উদ্যোগ, ফুড ম্যাজেমেন্ট ও আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রো প্রোডাক্ট প্রসেসিং টেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস জানান, কৃষিই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। আবহাওয়ার খামখেয়ালীর কারনে এলাকাভিত্তিক উপযোগী ‘ক্রপ জোন’ করতে হবে। একই জমিতে ৩এর অধিক ফসল উৎপাদনে স্বল্পজীবনকালের জাত উদ্ভাবন এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ‘লিগুমিনাস’ বা ডালসহ সিম্ব জাতীয় ফসল বছরে অন্তত একবার চাষ করার উপর জোর দিতে হবে। তাতে মাটির ক্ষয়রোধসহ নাইট্রোজেন সংযোজন হয়ে মাটি সমৃদ্ধ হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মহসীন আলী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির ফলে কৃষিতে অভুতপুর্ব উন্নতি হয়েছে। অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে আরো উন্নতি ঘটানোর জন্য পুরোপুরি যান্ত্রিকীকরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই হাইব্রিড প্রোডাকশনে ২০% থেকে ৪০% উন্নীত হবে ইনশাআল্লাহ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমে যাওয়া, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বত্বেও কর্মবীর কৃষকদের কারনে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ।
বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। কৃষির এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন। আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন।
কৃৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ও মৃত্তিকা সম্পদ ইন্সটিটিউটসহ কৃষি সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট ভূমির পরিমাণ ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৬৫ হাজার ২৮০ একর। এর মধ্যে মোট আবদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫শ’৫৬ হেক্টর। চাল উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৮৬লাখ ৩৪হাজার মেট্রিক টন। স্বাধীনতার পর দেশে আবাদযোগ্য জমি ছিল ১ কোটি ৮৫ লাখ হেক্টর এবং মোট খাদ্য উৎপাদন হতো ৯৫ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৬ লাখ হেক্টর।
কৃষি জমিতে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গড়ে তোলার ফলে আবাদী জমি উদ্বেগজনকহারে কমছে। প্রতিবছর আবাদী জমি কমছে গড়ে ৮২ হাজার হেক্টর জমি। যা মোট জমির এক ভাগ। বছরে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে এক হাজার হেক্টর জমি। সয়েল রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাধীনতার পর গত ৪০বছরে নদী ভাঙনে কৃষি জমির বিনাশ হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮শ হেক্টর।
আর এর বিপরীতে চর জেগেছে ৫৮ হাজার হেক্টর। ৮০ শতাংশ সরকারী খাস জমিসহ আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২ লাখ ২২ হাজার ৯শ’৭৭ হেক্টর। যা আবাদের আওতায় আনা হচ্ছে না।সুত্র জানায়, গত ৪০ বছরে শুধুমাত্র আবাদী জমিতে বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে প্রায় ৬৭হাজার একরে। অনাবাদি আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হলে কৃষি উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পেয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
জাতিসংঘের কৃষি ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ বর্তমানে চাল উৎপাদনে বিশ্বে চর্তুর্থ আর সবজি উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে। সবজিতে চীন এবং ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। সবজি উৎপাদন বেড়েছে ৫গুণ। চেষ্টা করলে অনায়াসেই দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে মাত্র ২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হতো, সেটা এখন ৬ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি আর বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটিতে। তা সত্বেও বাংলাদেশের কৃষি মুখ থুবড়ে পড়েনি বরং মাথা উচুঁ করে সগৌরবে চলমান রয়েছে। দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাত উদ্ভাবনে স্ফাল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ৬৭টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) করেছে ১৪টি ধানের জাত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি) ৪শ’১৭টি কমোডিটি ভ্যারাইটি অবমুক্ত করেছে। এর মধ্যে খাদ্যশস্য ৩৫, তেলজাতীয় ফসল ৪৩, ডালজাতীয় ফসল ৩১, সবজি ৮৯, ফল ৬৪, ফুল ১৬, মসলা ২৪টি জাত রয়েছে।
কৃষিতে সম্ভাবনা যেমন আছে তেমনি আছে বহুবিধ সমস্যা। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের কৃষি এখন অনেক উন্নত। সেখানকার চাষ পদ্ধতি ও ফসল উৎপাদন এবং কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থা পুরোটাই সরকার বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে আশানুরূপ উন্নতি হলেও ফুড ম্যানেজমেন্ট ও আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি। যার জন্য কর্মবীর কৃষকরা প্রায়ই উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য পান না। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ যেখানে সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত। বিশাল এই সেক্টরে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যে সমন্বয় ও উল্লেখযোগ্য নজর নেই বলে বিস্তর অভিযোগ।
মাঝেমধ্যে নানামুখী উদ্যোগ পরিকল্পনা নেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না, উপরন্তু দারুণভাবে অবহেলিত থাকছে সেক্টরটি। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেছেন, মাঠের যেসব সমস্যা আছে তা নিরসন করে কৃষক ও সামগ্রিক কৃষির উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে বাংলার কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।