শরীফুল ইসলাম: আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে প্রশাসনের প্রতিটি স্তর সাজবে নতুন রূপে। একাধিক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে আসছে পরিবর্তন। সরকারের আস্থাভাজন, মেধাবী ১৯৮৫ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্বে বসানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে তুলনামূলক অদক্ষ বলে প্রতীয়মান ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, এমন কয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডি ও ডাম্পিং পোস্টে পদায়ন করা হচ্ছে। মাঠ প্রশাসনের ডিসি ও ইউএনও পদেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ডিসি ফিটলিস্টের কাজ চলছে। পদোম্নতির চিন্তাভাবনা রয়েছে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব এবং সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে। সরকারি একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদকাল রয়েছে দেড় বছর। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ রকম উত্তরণকালে একদিকে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি রাজপথ গরম করে, অন্যদিকে প্রশাসনের ভেতর থেকে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা ধরনের চাপ ও অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা হয়। এসব বিষয়ে সরকার সচেতন। প্রশাসনের কয়েকটি পর্যায়ে রদবদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. কামালউদ্দিনকে তার পদ থেকে সরিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোস্তফা কামালকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর ড. কামালউদ্দিনকে দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের দায়িত্ব। দীর্ঘ দিন ধরে প্রশাসনের একটি অংশ কামালউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল। তাদের অভিযোগ, ড. কামালউদ্দিন বিএনপির আমলে ভালো অবস্থায় ছিলেন। তার পরিবারের কেউ কেউ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদিও ওই সচিব এসব অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছেন। সচিবের বরং দাবি, বর্তমান সরকারের বড় দুটো কাজে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। স্থল সীমান্ত চুক্তি এবং সমুদ্রসীমা বিজয়ের সময়ে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনীতি শাখার অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে ছিলেন।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান সমকালকে বলেন, প্রশাসনে পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে যে কয়েকজন সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের স্থলে নতুন সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে কয়েকজন সচিব অবসরে যাবেন। তাদের স্থলে কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। আর এটিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পদে রদবদল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স বিচার করা হবে। এগুলোকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবেই উল্লেখ করেন তিনি।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, সচিবদের তিন বছরের আমলনামা তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ১০টি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে। যেসব কর্মকর্তা তিন বছর সচিব হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে সিনিয়র সচিব করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে। যারা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সফলতা দেখাতে পারেননি, তাদেরকে ডাম্পিং পোস্টিং তথা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রান্তিক জায়গায় দেওয়া বা ওএসডি করা হতে পারে। তাদের স্থলে কয়েকজন দক্ষ অতিরিক্ত সচিবকে পদোম্নতি দিয়ে বসানো হতে পারে।
যারা তিন বছর ইউএনও এবং ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের প্রত্যাহার করা হবে। তাদের স্থলে সরকারের আস্থাভাজন মেধাবী কয়েকজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হবে। বিশেষ করে ২০তম ব্যাচের কিছু কর্মকর্তাকে ডিসি হিসেবে পদায়ন করার কাজ চলছে। আগামী নির্বাচনকালে এ কর্মকর্তারা ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে কয়েকজন দপ্তরপ্রধানকেও সরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চৌকস কিছু কর্মকর্তাকে এ পদে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে, যারা সঠিক সময়ে সরকারের নির্দেশনা পালন করতে পারবেন।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীর চাকরিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ডিসেম্বরে। আবারও তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না পেলে তাকে সরকারের অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মুখ্য সচিব পদে নিয়োগ পেতে পারেন জনপ্রশাসন সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান। এ কর্মকর্তা প্রশাসনে সজ্জন হিসেবে পরিচিত। বিএনপির আমলে তিনি পদে পদে বঞ্চিত ছিলেন। ওই পদে নিয়োগের জন্য বর্তমানে তার ব্যাচে তিনিই সিনিয়র কর্মকর্তা। এ বিবেচনায় তাকেই মুখ্য সচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনা জোরালো। সে ক্ষেত্রে তার স্থলে শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসেনকে দায়িত্ব্ব দেওয়া হতে পারে। আর ‘৮৫ ব্যাচের এক কর্মকর্তাকে দেওয়া হতে পারে শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব।
আগামী মাসে বর্তমান ভূমি সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এ পদে দায়িত্ব পেতে পারেন নতুন কোনো কর্মকর্তা। নৌ-সচিব ও ধর্ম সচিব পদেও আসছেন নতুন কর্মকর্তা। পরিবর্তনের তালিকায় রয়েছেন এনবিআরের চেয়ারম্যানসহ আরও চার সচিব। ‘৮৫ ব্যাচের দক্ষ ও মেধাবী ৫ কর্মকর্তাকে ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
সূত্র জানায়, সরকারি কাজকর্মে গতি আনতে মাঠ প্রশাসনেও বড় ধরনের রদবদল আসছে। আগামী ডিসেম্বরের আগেই মাঠ প্রশাসনের ডিসি, এডিসি ও ইউএনও পদে প্রায় দেড়শ’ কর্মকর্তার দপ্তর বদল করা হচ্ছে। তালিকায় রয়েছেন ডিসি পদে ২৫ জন, এডিসি পদে প্রায় ৪০ জন এবং ইউএনও পদে প্রায় ৯০ জন কর্মকর্তা।
ইতিমধ্যে তৈরি ফিটলিষ্ট থেকে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন নিয়ে ডিসি পদে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। বর্তমানে কর্মরত ডিসিদের মধ্যে যারা যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোম্নতি পেয়েছেন এবং যারা অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, এমন কয়েকজন ডিসিকে প্রত্যাহারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
প্রশাসনের ২৫তম ব্যাচের ৪০ জন কর্মকর্তাকে এডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ে তিন বছর ইউএনও পদে যাদের মেয়াদ পার হয়েছে এবং যারা এ পদে কর্মরত থাকাবস্থায় অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন এমন ৯০ জন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রশাসনে সিনিয়র সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোম্নতি দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে বিগত সময়ের এ পদে পদোম্নতিতে ১৮, ২০, ২১ ও ২২তম ব্যাচের যেসব কর্মকর্তা বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ স্থান পাবেন এ তালিকায়। পদোম্নতি দেওয়া হচ্ছে যুগ্ম সচিব পদে। এ পদে পদোম্নতিতে বিবেচনায় রয়েছেন ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা। অতিরিক্ত সচিব পদে পদোম্নতির জন্য বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে ৯ম ও ১০ম ব্যাচের কর্মকর্তাদের। বিগত দিনে বঞ্চিতদের মধ্য থেকেও কিছু কর্মকর্তার ঠাঁই হতে পারে এ তালিকায়।