স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়টি এবং এসডিজি পরস্পর আন্তঃসম্পর্কিত। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়কে অবহেলা করে এসডিজি অর্জন করা আমাদের জন্য কঠিনতর হবে। বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭টি-জীবন পরিবর্তনের লক্ষ্যের মাধ্যমে গ্রহ এবং এর নাগরিকদের জীবনকে উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা ২০১৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে। লক্ষ্যগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএং) নামে পরিচিত।
এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রচার করা অন্যতম। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা-৩ এ ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে। এর লক্ষ্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করা এবং সবার জন্য নিরাপদ ও কার্যকর ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের সুযোগ সৃষ্টি করা।
সংক্রামক রোগ একসময় বাংলাদেশের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুবিধা নির্মাণ এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ এ ধরনের রোগ প্রতিরোধে উলেস্নখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোগের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, তামাক দ্রব্য ব্যবহার, অতিরিক্ত ক্যালরি (চর্বি ও চিনি), অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, মানসিক চাপ বৃদ্ধি, মোবাইল ফোন ও অনলাইন মাধ্যমে আসক্তি ও মাঠে খেলার সুযোগ কম থাকার কারণে অসংক্রামক রোগের পরিধি এখন আরও বাড়ছে।।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশ দূষণকেও অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী করা হয়। এটা সকলের জানা যে, সারা বিশ্বে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং দীর্ঘ শ্বাসযন্ত্রের রোগের মতো অসংক্রামক রোগগুলো ৭১% মৃতু্যর জন্য দায়ী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) মতে, ৬৭% মৃত্য অসংক্রামক রোগের কারণে হয়, যার ফলে বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
অসংক্রামক রোগের বিস্তার বাংলাদেশের জন্য সর্বাত্মক উন্নয়ন অর্জনে একটি বড় বাধা। বাংলাদেশ এখন ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অর্জনের জন্য কাজ করছে। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষের সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
এই মুহূর্তে চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নিলে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। তাই স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, বিশেষ করে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে আরও বিনিয়োগ করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের ফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না, বরং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। তাই জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং জাতীয় স্বার্থে এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যদিকে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ করতে হবে।
এই বিষয়ে গবেষণা, প্রচার এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করাও গুরুত্বপূর্ণ।
আগের বাজেটে সরকার স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বাজেটের ৫.৪ শতাংশ বরাদ্দ করেছিল এবং এই বছরের বাজেটে দেশের উচ্চ পকেটের বাইরের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের মধ্যে মোট বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, বাজেট পকেটের বাইরের ব্যয় বাড়িয়ে দেবে যা স্বাস্থ্যসেবা পেতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের শাখা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস অনুসারে, ২০২০ সালে লোকেরা তাদের পকেট থেকে ১০০ টাকার প্রতিটি স্বাস্থ্য ব্যয়ের জন্য ৬৮.৫ টাকা ব্যয় করেছে, পাঁচ বছর আগে তাদের পকেটের বাইরের ব্যয় ৬৭ টাকা থেকে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে, আফগানিস্তানের পরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পকেটের স্বাস্থ্য ব্যয় রয়েছে যেখানে পকেটের বাইরে স্বাস্থ্য ব্যয় ৭৮ শতাংশ।
১৯৯৭ সালে দেশে পকেটের বাইরের স্বাস্থ্য ব্যয় ছিল ৫৫ শতাংশ যা বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত বেড়েছে যখন স্বাস্থ্যে জনসাধারণের অর্থায়ন ১৯৯৭ সালে ৩৭ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে ২৩ শতাংশের কিছু বেশি কমেছে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে তার জাতীয় বাজেটের প্রায় ৫ শতাংশ ব্যয় করে চলেছে, যা বিশ্বের সর্বনিম্ন স্বাস্থ্য বিনিযয়োগগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাস্থ্য বাজেটে মোট বরাদ্দের অন্তত ৮ শতাংশ হতে হবে।
মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ৪৫ ডলার, যেখানে নেপালে ৫৮ ডলার, ভারতে ৭৩ ডলার, ভুটানে ১০৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় ১৫৭ ডলার।
আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার বিকল্প নেই। তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক এবং টেকনিশিয়ানের মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য সরকারের একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা অপরিহার্য।
জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। অন্যদিকে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে এবং বেসরকারি খাত কর্তৃক প্রদত্ত সেবার মান এবং রোগীদের কাছ থেকে তাদের আদায় করা ফি এর বিষয়ে তদারকি করতে হবে। তাহলে আশা করি যে, জনগণ প্রকৃত সুফল পাবে।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের মতো জটিল রোগে ভুগছেন এমন দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ এবং চিকিৎসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারের।
সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের কারণে মানুষের গড় বয়স এখন বাড়ছে, অন্যদিকে বার্ধক্যজনিত রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। সরকারের এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা উচিত।
সরকারের একার পক্ষে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সরকারি, বেসরকারি ও উন্নয়ন সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ব্যক্তি পর্যায়েও সচেতনতা থাকতে হবে। অসংক্রামক রোগ আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জরুরি ও জটিল রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটি কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা করা জরুরি। কমিউনিটি ক্লিনিক/মেডিকেল সাব-সেন্টার থেকে উপজেলা হাসপাতাল, উপজেলা থেকে জেলা হাসপাতাল এবং জেলা হাসপাতাল থেকে টারশিয়ারি বা বিশেষায়িত হাসপাতালে একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম দেশে এখনও তৈরি করা হয়নি। ফলে চিকিৎসা কার্যক্রমে এক ধরনের সমন্বয়হীন অবস্থা বিরাজ করছে। স্বাস্থ্য সেবা একটি সম্পূর্ণ দলগত কাজ। এই দলের প্রধান হবেন একজন চিকিৎসক, তাদের সঙ্গে থাকবেন তিনজন নার্স। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুসারে, প্রতিটি দলে ২২ জন প্রশিক্ষিত সদস্য থাকবে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের অর্ধেক রয়েছে। গত তিন দশকে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি খাতের তুলনায় বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতকে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনায় সদিচ্ছার স্পষ্ট অভাব রয়েছে। এখন সময় এসেছে বেসরকারি খাতকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলা ও তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার।
আমরা স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অবহেলা করতে পারি না, কারণ মানুষের সুস্বাস্থ্য একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন ও জনগণের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না করা গেলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করার জন্য এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরি।
লেখক: ড. সমীর কুমার সাহা – পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক।