গত ১৭ আগস্ট বেলা ১১টায় পাবনা সদর থানা এলাকা থেকে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ একটি কল আসে। কলটি রিসিভ করেন পুলিশ কনস্টেবল সুমি খাতুন। অপর প্রান্ত থেকে একটি মেয়ে সুমি খাতুনকে জানান, মেয়েটির বাবা তাকে এবং তার মাকে মেরে ফেলার জন্য একটি কক্ষে আটকে রেখেছেন। বাবার প্রত্যাশা ছিল পুত্রসন্তানের, কিন্তু ছেলে না হয়ে মেয়ে হওয়া মানতে পারেননি তিনি। আর এটাই মেয়ের অপরাধ। আর মা তার মেয়েকে সমর্থন করেন বলে মা-মেয়েকে আটকে রেখে মেরে ফেলতে চান বাবা। এমন পরিস্থিতিতে সহযোগিতার জন্য মেয়ে ৯৯৯-এ কল করেন ভুক্তভোগী মেয়ে। পরে ৯৯৯ এর পক্ষ থেকে থানায় জানালে ব্যবস্থা নেয় পুলিশ।
রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে ৯৯৯-এ কল করেন এক গার্মেন্টস কর্মী। স্বামীর মারধরের শিকার হয়ে সহযোগিতা চান তিনি। ভুক্তভোগী জানান, আগে তিনি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। কিন্তু সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যান গ্রামে। চাকরি করার সময় সম্পর্ক ভালো থাকলেও চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর মারধর করতে থাকেন স্বামী। এমনকি বাড়ি থেকে চলে যেতেও বলেন স্বামী। পরে থানা পুলিশকে অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান কনস্টেবল সুমি খাতুন।
প্রতিদিন এমন নানা বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে ৯৯৯-এ কল করের অসংখ্য মানুষ। আর এসব ফোনকল রিসিভ করা ও ৯৯৯ এর কার্যক্রম চালানোর জন্য সুমি খাতুনের মতো প্রায় ৪৫০ জন পুলিশ সদস্য ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে থাকেন।
২০২৬ সালের ১ অক্টোবর প্রথমে গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কে ৯৯৯ নম্বরে জাতীয় হেল্প ডেস্ক চালু হয়। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সেখানে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলে। সেই বছরের ৮ অক্টোবর ৯৯৯ নম্বর পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচালনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২৬ অক্টোবর থেকে ৯৯৯ এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর আবদুল গনি রোডে পুলিশের সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ফায়ার সার্ভিস, জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশি সেবা দিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। মোবাইল ও ল্যান্ডফোন থেকে সম্পূর্ণ টোল-ফ্রি কল করে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এই সেবা নিতে পারেন দেশের মানুষ।
গত ১৭ আগস্ট সরজমিনে দেখা গেছে, সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলায় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর অফিস। দুটি ফ্লোরেই আছে অভ্যর্থনা কক্ষ। সেখানে যে কেউ ৯৯৯ এর সহযোগিতা বা প্রয়োজনীয় কাজের বিষয়ে অবহিত করে সেবা নিতে পারেন। দুটি ফ্লোরের বিশাল অংশই উন্মুক্ত। অফিসে প্রবেশ করেই কানে আসতে থাকে একের পর এক ল্যান্ডফোনে কল আসার আওয়াজ। প্রথমে মনে হবে যেন কোনো মোবাইল ফোন কোম্পানির বড় কল সেন্টার। ফোনে কেউ কথা বলছেন ভুক্তভোগীর সঙ্গে, কেউ আবার কথা বলছেন পুলিশ সদস্য বা সহযোগিতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে।
প্রত্যেকের জন্য আলাদা চেয়ার, কম্পিউটার ও টেলিফোনসহ ডেস্ক রাখা আছে। একসঙ্গে প্রায় ১০০ জন পুলিশ সদস্যকে এসব ডেস্কে বসে কাজ করতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ২৪ ঘণ্টায় কতটি কল আসছে এবং কতটির সমাধান হয়েছে, কতজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন তা একটি মনিটরে দেখা যায়। কতটি কল প্রক্রিয়াধীন সেই চিত্রও মনিটরেই দেখতে পারেন যে কেউ। সেখানে তিনটি স্তরে কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা।
১৭ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টার শিফটে প্রথম রেসপন্স করা পুলিশ সদস্য ৬১ জন, দ্বিতীয় রেসপন্স করা পুলিশ সদস্য ১৩ জন, আর চারজন সুপারভাইজারকে কাজ করতে দেখা যায়। রাত ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মনিটরে দেখ যায়, ১০ হাজার ৩৮৭টি ফোন কল এসেছে ৯৯৯-এ। এসব সেবাগ্রহীতাদের সহজে ও দ্রুত সময়ে সেবা নিশ্চিত করতেই এভাবে তিনস্তরে ভাগ করে কাজ করেন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা।
৯৯৯ এর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা, ২টা থেকে রাত ১০টা এবং রাত ১০টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত অফিসটিতে তিন শিফটে কাজ করেন পুলিশ সদস্যরা। চারটি টিমে ভাগ হয়ে ২৪ ঘণ্টা এই সেবা দেন তারা। প্রতিদিন ২২-২৫ হাজার কল আসে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯-এ। একসঙ্গে ৮০টি কল গ্রহণ করতে পারে ৯৯৯। প্রথম রেসপন্সের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা এই কাজটি করেন। ২০টি কল থাকে সেবা কার্যক্রমের আপডেট জানার জন্য যা দ্বিতীয় রেসপন্সের দায়িত্বরতরা করেন। আর পুরো বিষয়টি সুপারভাইজ (তদারকি) করেন সুপারভাইজাররা।
৯৯৯-এ আসা কলের প্রথম রেসপন্স করা সদস্যরা হলেন নারী ও পুলিশ কনস্টেবল। মনিটরিং ও ফলোআপ করেন সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) ও উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। পরিদর্শকরা (ইন্সপেক্ট) হলেন সুপারভাইজিং কর্মকর্তা। পরিদর্শকরা প্রশিক্ষণ টিম, কোয়ালিটি টিম, তদন্ত (ইনকোয়েরি) টিম এবং প্রতিক্রিয়া (ফিডব্যাক) টিমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তারা অ্যাডমিন (প্রশাসন) ও মিডিয়া (গণমাধ্যম) কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ একজন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, একজন পুলিশ সুপার (এসপি), দুজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি), ৩৬ জন পরিদর্শক (ইন্সপেক্ট), ৩০ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই), ৩৬ জন সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই), ২৬৮ জন পুরুষ কনস্টেবল, ৫৩ জন নারী কনস্টেবল- সবমিলিয়ে ৪৪০ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
যখন কোনো ব্যক্তি ৯৯৯-এ কল দেন তখন পুলিশের প্রথম রেসপন্সার প্রথমেই থানার সহায়তা হলে পুলিশের সঙ্গে, ফায়ার সার্ভিসের হলে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আর অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের দরকার হলে সংশ্লিষ্ট অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে সার্ভিসটি ফলোআপ করেন। যারা সহযোগিতা করছেন তারা গেলেন কি না, গিয়ে কী সার্ভিস দিলেন সবকিছুই জানেন, নিশ্চিত হন। পরে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানেন তিনি সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট কি না। কোনো কারণে সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট নয়, এমন তথ্য পেলেই অপর একটি টিম কাজ করে। তখন জানার চেষ্টা করেন কেন সন্তুষ্ট নয়।