1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবারের দায়িত্বশীলতা

আবুল কাশেম উজ্জ্বল : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে ডানপিটে ছেলে, মাস্তান, যারা এলাকায় হৈ-হুল্লোড়, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে মারামারির মতো ঘটনা ঘটাত তাদের কিশোর অপরাধী হিসেবেই সবাই জানত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের গতি, প্রকৃতি ও স্বভাবে এসেছে আরও নেতিবাচক পরিবর্তন। বিগত কয়েক দশকে দেশে কিশোর অপরাধের পরিসংখ্যানই বলছে আমাদের কিশোররা কীভাবে প্রচলিত আইন ও সামাজিক অনুশাসনের জাল ছিন্ন করে সাধারণ অপরাধ থেকে খুন, ধর্ষণসহ জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে এবং এর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অপরাধের মাত্রা বয়স্ক অপরাধীদের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে, তাদের সংশোধনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাতে করে তাদের সংখ্যা ও অপরাধ কমছে না।

কিশোর অপরাধের পরিসংখ্যান নিয়ে যেসব তথ্য আছে, তা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেবল কিশোর অপরাধীর সংখ্যাই বাড়ছে না, একই সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরন ও ভয়াবহতা বদলে যাচ্ছে; যার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে কিশোর গ্যাং। ‘কিশোর গ্যাং’-এর মতো বিষয়গুলো সবার সামনে আসে ২০১৭ সালে আদনান কবিরের মৃত্যুর পর। আরেকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা, যেটি পুরো দেশের মানুষকেই আতঙ্কিত করেছিল, সেটি ঘটেছিল ২০১৯ সালে বরগুনায়। পুলিশের তথ্যমতে, রাজধানীতেই প্রায় ৫০-৭০টি কিশোর গ্যাং আছে; যার সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজার। ঢাকার মতো দেশের অনেক শহর, এমনকি গ্রাম এলাকায়ও কিশোরদের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার নজির কম নয়।

দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ কোটি বা প্রায় ৩০-৩২ শতাংশ শিশু-কিশোর। বিভিন্ন পরিসংখান বলছে, তাদের এক-তৃতীয়াংশের অধিক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। আবার তাদের মধ্যে মাদকাশক্তির প্রবণতাও বেশি, ফলে অতি সহজেই তাদের যে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা অতি প্রকট। কিশোর অপরাধের গতিময়তা হত্যা, ধর্ষণসহ মারাত্মক কুৎসিত অপরাধে কলুষিত। কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের প্রতিষ্ঠিত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যমতে, কেন্দ্রে অবস্থানরত ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক সেবন, ক্রয় ও বিক্রয়, অস্ত্র ব্যবহার-ব্যবসা ইত্যাদি জঘন্য অপরাধে জড়াতে তারা নানাভাবে প্ররোচিত হচ্ছে।

কিশোররা কেন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের অনেক অভিমত আছে। এমনকি অনেক থিওরিও এর কারণ বিশ্নেষণ করার চেষ্টা করে, যদিও সমাজ ও পরিস্থিতিতে কারণগুলো ভিন্ন হয়। মনোবিজ্ঞানী বার্নার্ড রিমল্যান্ড ২০০৮ সালে তাঁর বই ‘ডিস লজিক সিনড্রোম’-এ বলেন, মানুষের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড আসলে বাছাইগত নয় বরং জিনগত; শারীরিক অথবা মানসিক বৈশিষ্ট্যের ফসল। তিনি অপ্রতিকূল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশকে অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন। তবে জিনগত সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অনেকে মেনে না নিলেও পরিবেশগত প্রভাবের কথাটি অনেকেই স্বীকার করেন। অপরাধ বিজ্ঞানী সাদারল্যান্ড কিশোরদের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে পরিবার, বন্ধু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলোর দুর্বলতাকে দায়ী করেন। প্রায় অনুরূপ মত দেন ক্লিফোর্ড শ’ ও হেনরি মেক। তাঁদের মতে, অনুকূল এবং সংগঠিত পরিবেশে থাকলে মানুষ অপরাধহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়; অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর ও অব্যবস্থাপূর্ণ পরিবেশে কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা বেশি থাকে।

কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া বহুলাংশে নির্ভর করে সামাজিকীকরণের অন্যতম মাধ্যম পরিবারের দায়িত্ববোধ বা দায়িত্বহীনতা। অতীতে আমাদের সমাজে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে কিশোরদের যে কোনো বিচ্যুত আচরণের বিচার বা সমাধান করা হতো। এখনও গ্রামাঞ্চলে, এমনকি শহরে দুর্বলভাবে হলেও সে রকম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা লক্ষ করা যায়। তখন মানুষ বিচারের জন্য পুলিশ বা আদালতে না গিয়ে কিশোরদের অভিভাবক বা প্রয়োজন হলে সমাজপতিদের কাছে যেত এবং এভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করত। পরিবারগুলোও কোনো অভিযোগ পেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করত; যাতে তার কিশোরটি ভবিষ্যতে আর অপরাধে জড়িয়ে না যায়। তাই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পরিবারের ভূমিকার বিষয়টি ব্যাপক।

কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সুযোগের অসমতাসহ অনেক কারণের কথা বলা হলেও পারিবারিক শিক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অনেক সময় অবহেলিত বা অনুচ্চারিত থেকে যায়। পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন অনেককে অপরাধের পথে নিয়ে যায়, তেমনিভাবে অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও একটা কারণ। অভিভাবকদের শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, ইত্যাদি যেমন ওই পরিবারের শিশু-কিশোরদের নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দিচ্ছে, তেমনি বিপরীত চিত্রও বিদ্যমান। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক কিশোর যেমন শিক্ষা ও অন্যান্য যোগ্যতায় নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে, তেমনি সুযোগের সীমাবদ্ধতা বা অবারিত সুযোগ থাকার পরও অনেক কিশোর গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে অপরাধী হচ্ছে। তাই কেবল অভাব, বৈষম্য, অশিক্ষা বা জৈবিক কারণগুলোর প্রভাব থাকলেও পরিবারের ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

পারিবারিক নিয়ন্ত্রণহীনতা বা শিথিলতা শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণকে প্রভাবিত করে, যা পরীক্ষিত সত্য। পরিবার হচ্ছে শিশুর প্রথম শিক্ষালয়, যেখানে তারা নীতি-নৈতিকতা, ভালো-মন্দের প্রার্থক্য এবং সমাজের প্রত্যাশিত আচরণ শিক্ষা করে থাকে। অভিভাবকদের উপযুক্ত নির্দেশনা, তত্ত্বাবধান ও গঠনমূলক নিয়ন্ত্রণ থাকলে শিশুর পক্ষে সহজে অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বর্তমান সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর দিকে তাকালেই এ সহজ সত্যটি উপলব্ধি করা যায়। অনেক সময় শিশুদের ছোট ছোট ভুলকে অভিভাবকরা অবহেলা করেন বা সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়াতে পরবর্তী সময়ে তা স্থায়ী আচরণে পরিণত হয়।

অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা যেমন কিশোরদের মনে দাগ কাটে, তেমনি প্রাচুর্য্যও। অভিভাবকদের ঠিক করতে হবে সন্তানদের প্রত্যাশার মাত্রা কতটুকু হওয়া উচিত। তাদের সব আবদার সহজে মেনে নেওয়ার মধ্যে তাদের মধ্যে যে সহজাত পাওয়ার ভাবনা তৈরি হয়, তা কি সব সময় ভালো? আবার তাদের বয়সের সঙ্গে সংগতি রেখে চাহিদা পূরণের দায় কিন্তু অভিভাবকদের। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর হাতে যদি দামি স্মার্টফোন দেওয়া হয় তাহলে এর ফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। বিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তান কেন বিদ্যালয়ে বা নামাজে যাওয়ার সময় সঙ্গে মোবাইল নিয়ে যাবে? সে মোবাইল দিয়ে সন্তান কী করে, তা ক’জন অভিভাবক সচেতনভাবে তদারক করেন? অনুরূপভাবে সন্তানদের হাত খরচের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সামর্থ্য আছে বলেই কিশোর সন্তানকে ইচ্ছেমতো টাকা দেওয়া পক্ষান্তরে তাদের বিপথগামী করা। বাড়তি টাকা দিয়ে সিগারেট বা মাদক সেবন যে করবে না সে নিশ্চয়তা কতটুকু?

আজকের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে অভিভাবকরা সন্তানদের প্রয়োজনীয় সময় দিচ্ছেন কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির এ যুগে সবাই নিজের ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত। একই ছাদের নিচে বাস করেও সবার জগৎ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ও ইউটিউবের ব্যবহার এত বেশি হচ্ছে, মা-বাবা নিজেরাই খেয়াল করছেন না যে তাদের সন্তানদের একাকিত্ব। ফলে তাদের মানসিকতা হচ্ছে ভিন্ন। এমনকি বিনোদনের সঠিক সুযোগ না থাকায় তাদের মধ্যে কিছু করার তাড়না তৈরি হয়; যা পক্ষান্তরে তাদের মধ্যে বিচ্যুত ভাবনার জন্ম দিচ্ছে।

অনেক অভিভাবক শিশু সন্তানদের সময় দিতে না পেরে তাদের মোবাইল বা ল্যাপটপ দিয়ে ব্যস্ত রাখেন। তাদের বোধশক্তি বড়দের ন্যায় না হওয়ায় সহজেই তারা এমন সব সাইট ভিজিট করে, যা তাদের মানসিকতা বদলে দিতে পারে। অভিভাবকরা কি সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের গতিবিধি মনিটর করেন? অনলাইন শিক্ষার নাম করে শিশু-কিশোররা যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী করছে, সে দিকটি খেয়াল রাখার দায় কিন্তু অভিভাবকদের। অনেকে তাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের নামে সামাজিক মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট করে দেন কিন্তু পরে আর জানার চেষ্টা করেন না সেটা কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে। তাদের নামে অ্যাকাউন্ট থাকা কি খুব জরুরি? অনেক অভিভাবক সন্তানদের ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও আপলোডকে নিজেদের জন্য সম্মানজনক ভাবেন। বরং এটা নিয়ে তাঁরা অন্যদের কাছে প্রচারও করেন। কিন্তু একবারও কি ভাবেন যে এভাবে শিশুটির ভাবনার জগৎটা অস্বাভাবিক করছি?

সন্তানটি কার সঙ্গে মিশছে বা রাতে কেন দেরি করে ফিরছে- তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু পুলিশের নয়, মা-বাবার। সন্তানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলে তা রোধ করা তাদের আবশ্যিক দায়িত্ব। কিন্তু কারও কারও ভাবনা ভিন্ন; মনে করেন ছেলেটা বড় হচ্ছে, একটু স্বাধীনতা দরকার। তা ঠিক, কিন্তু সেটার মাত্রাও দেখার বিষয়। অথচ এক সময় আসে যখন সে আর সীমার বাইরে চলে যায় আর অভিভাবকদের জন্য থাকে হাহাকার।

এ রকম অনেক দায়িত্ব আছে পরিবারের, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল হচ্ছে; ফলে কিশোররা হচ্ছে বিচ্যুত। তাই কিশোর অপরাধ রোধে পরিবারের ইতিবাচক ভূমিকা জোরালো না করলে আইন দিয়ে সেটা রোধ করা প্রায় অসম্ভব।

লেখক : আবুল কাশেম উজ্জ্বল – শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।


সর্বশেষ - রাজনীতি