দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা সেতুর টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান।
তিনি বলেন, ৩০ আগস্টের মধ্যে সেতুর মূল কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধুমাত্র সেতুতে লাইটিংয়ের কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তারিখ ঘোষণা হলেই চূড়ান্ত হবে উদ্বোধনের দিনক্ষণ। সেই অপেক্ষায় আছেন সেতু কর্তৃপক্ষসহ গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার কোটি কোটি মানুষ। মুখিয়ে আছেন যাত্রীবাহী বাসসহ অন্যান্য যানবাহন সংশ্লিষ্টরা। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কালনা সেতু নির্মিত হয়েছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মতি পেলে অক্টোবরের যে কোনো দিন সেতুটি উদ্বোধন হবে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ৭ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের গণমাধ্যম কেন্দ্রে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত ‘বিএসআরএফ সংলাপ’-এ অংশ নিয়ে এ কথা বলেন মন্ত্রী।
অপরদিকে কালনা সেতুর টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় ট্রেইলার ৫৬৫ টাকা, তিন বা ততধিক এক্সসেল বিশিষ্ট ট্রাক ৪৫০ টাকা, দুই এক্সসেল বিশিষ্ট মিডিয়াম ট্রাক ২২৫, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কনভারশনকৃত জিপ ও রে-কার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটোটেম্পু, সিএনজি অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিনচাকার যান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেল পাঁচ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উদ্বোধনের পর প্রথমে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে টোল আদায় করা হবে। পরবর্তীতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে টোল আদায় হবে। এক্ষেত্রে প্রায় এক মাস সময় লাগবে। অপারেটরের মাধ্যমে টোল আদায় হবে।
সেতু কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয়রা জানান, এপারে নড়াইলের কালনাঘাট। ওপারে গোপালগঞ্জের শংকরপাশা। মাঝ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদী। এ নদীর ওপরই নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা সেতু।
কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, কালনা দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু এটি। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার। উভয় পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা। এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত এটি। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, ভাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ভূমিকা রাখবে। তবে এতদিন কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদী ধারা বিচ্ছিন্ন ছিল। সেতু নির্মাণের ফলে সেই বিচ্ছিন্নতা আর রইল না। কালনা সেতু চালু হলে শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। ভারত, কলকাতা, আসামসহ দেশের মধ্যে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে। নড়াইলের লোহাগড়ায় ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) চালুসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
কালনাঘাটে স্থাপিত নামফলক থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালনা সেতু’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কালনাঘাট থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। ফলে ঢাকার সঙ্গে নড়াইল, বেনাপোল, যশোর, খুলনাসহ আশপাশের সড়ক যোগাযোগ কোথাও ১০০ কিলোমিটার, কোথাও আবার ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে। তবে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ নির্মাণ করা হলেও ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এ ধরনের সড়ক নির্মিত হয়নি। ফলে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’র সুফল পাচ্ছে না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বড় একটি অংশ। ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর-বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমানে দুই লেন সড়ক চালু আছে।
এই অংশে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ সড়ক নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পাধীন বলে জানিয়েছেন কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, কালনা সেতু চালু হলে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে। তাই আপাতত যশোরের মনিহার সিনেমা হল চত্বর থেকে নড়াইলের কালনাঘাট পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে সড়কটি ১৮ ফুট প্রশস্ত থাকলেও তা বাড়িয়ে ২৪ ফুট করা হবে।
দরপত্রের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দরপত্র অনুমোদন হলে দুই সপ্তাহের মধ্যে ওয়ার্কঅডার দিব। নড়াইল অংশে প্রায় ৪৭ কোটি এবং যশোর অংশে ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক প্রশস্তকরণ করা হবে। এক বছরের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। এ লক্ষ্যে সড়কের দুই পাশে গাছকাটার কাজ শুরু হয়েছে।
যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা মিঠু বলেন, কালনা সেতু চালু হলে যশোর, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, মাগুরাসহ পাশের জেলাগুলোর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে যাবে। খুব সহজেই রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যাতায়াত করা যাবে। আমরা কালনা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি।
এদিকে কালনা সেতু চালু না হওয়ায় নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, নোয়াপাড়া শিল্পনগর, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার লোকজন পদ্মা সেতুর সরাসরি সুফলও পাচ্ছেন না। কারণ, কালনাঘাটে এসে ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে সব ধরনের যানবাহনকে। তাই এ অঞ্চলের সবাই তাকিয়ে আছেন কালনা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঘোষণা করবেন-এমন প্রত্যাশা সবার।