1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বিশ্বনেতাদের শোকগাথা ও মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু

মুসা সাদিক : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পনের আগস্টে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের যে বীজ বপন করা হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্রের গুপ্ত কথা জানতে আমি এক সরকারি কাজে চট্টগ্রাম গিয়ে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে ১৯৯৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাঁর ১১৫/বি, জামাল খান রোডের বাসায় সাক্ষাৎ করেছিলাম। ওই সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর ছেলে ডা. মঈনুল ইসলাম চৌধুরীসহ পরিবারের আরও লোকজন উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তাঁর বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে শুয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির অজানা রহস্যের পর্দা তিনি উন্মোচন করেছিলেন।

তিনি বারবার বাক্‌রুদ্ধ কণ্ঠে, চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি- এর দায়দায়িত্ব সফিউল্লাহ, সেনাবাহিনী, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর চেয়ে আমার সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু আমি একজনের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলাম।’ তিনি বিশ্বাসঘাতক বলতে জিয়াউর রহমানের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর সামনে তাঁকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘স্যার, বঙ্গবন্ধুর গায়ে আঁচড় লাগার আগে আমার বুক বুলেটে ঝাঁঝরা করতে হবে।’

১৯৭৫ সালের আগস্টের ৪ ও ৫ তারিখ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কার্যালয়ে (শিল্প ভবন) তদানীন্তন প্রতিরক্ষা সচিব মুজিবুল হকসহ আর্মির ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে পদাতিক বাহিনীর কাঠামো বিন্যাস (আরেকটি ব্রিগেড গঠন বিষয়ে) সম্পর্কিত একটি মিটিং করছিলেন; সে সময় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে রেড টেলিফোনে একটি ফোন কল পান। সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের তিনজনের মিটিং চলাকালে বঙ্গবন্ধু আমাকে রেড টেলিফোনে ফোন করলেন। তিনি জানালেন, জেনারেল সফিউল্লাহকে আর্মির চিফ হিসেবে আরও এক টার্ম (অর্থাৎ আরও তিন বছর) নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছি। এ-সম্পর্কিত গেজেট নোটিফিকেশন আজই ছাপা হবে।’

জিয়া বিষয়টা বুঝে গেছেন বলে তখন আমিও তাঁদের বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের কথাটা বললাম। এতে জেনারেল জিয়াকে খুবই বিপর্যস্ত ও ক্ষুব্ধ হতে দেখলাম। তিনি আমার সামনে থেকে একটি সাদা কাগজ টেনে নিয়ে তৎক্ষণাৎ স্বহস্তে ইংরেজিতে তাঁর পদত্যাগপত্র লিখে আমার কাছে পেশ করলেন। আমি জিয়াউর রহমানকে আমাকে দু-এক দিন সময় দেওয়ার জন্য বললাম। কিছুটা ক্ষুব্ধ ও বিমর্ষ জিয়া কোনো কথা না বলে আমাকে স্যালুট করে চলে গেলেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর ঢাকা আগমনের আগেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিষয়ক আমার লেখা ১০০০ পৃষ্ঠা সংবলিত বই ‘Bangladesh Wins Freedom’ লেখকের উপহারস্বরূপ কুয়ালালামপুরে তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই সূত্রে তাঁর অফিসের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় এবং আমার সঙ্গে ঢাকায় তাঁর সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারিত হয়। সে অনুযায়ী হোটেল সোনারগাঁওয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আমার বইটি তাঁর হাতে তুলে দিই। তাঁর সঙ্গে আমার সেই সাক্ষাৎকারের ছবি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সে সময় ছাপাও হয়েছিল। তিনি আমার বইটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘তোমার বই পুরোটা আমি পড়ে এসেছি। নেলসন ম্যান্ডেলার চেয়ে তোমাদের শেখ মুজিবের কৃতিত্ব অনেক বড়। বিশ্ব-মানব জাতির ইতিহাসে এমন কোনো নেতা নেই, যিনি বন্দি অথচ যাঁর নামে একটি দেশ ও ভূখণ্ড স্বাধীন হয়েছে ও একটি জাতি তাঁর নামের শক্তি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তাঁর জাদুকরী নামের মতো আর কোনো জাদুকরী নাম ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা কোথাও এ যাবৎ খুঁজে পাবে না। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে বাংলাদেশ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ও এতিমের মতো অবহেলা ও অবজ্ঞার মধ্যে অগ্রসর হচ্ছে। আমার নিজের কথা বলছি না; তোমাদের প্রতিবেশী ভারত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নামে এবং অন্য অনেক দেশ তাদের স্বাধীনতার রূপকারদের নামে উন্নতি ও সমৃদ্ধির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। তোমাদের জাতির ভাগ্যে সেখানে বড় একটা ট্র্যাজেডি দেখে খুব অনুতাপ হয়। আফসোস হয়।’

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহান মানুষের কণ্ঠে আমাদের জাতির পিতা সম্পর্কে এমন আন্তরিক বিশ্নেষণ আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। আবেগে আমার কণ্ঠস্বর বুজে এলো এবং চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। আমি কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম এবং মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পক্ষ থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলাম।

বঙ্গভবনে আমি ১৯৭২ থেকে (১৯৭৭-‘৮১ ব্যতীত) ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছয়জন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিভিন্ন পদমর্যাদায় চাকরিসূত্রে তাঁদের রাষ্ট্রীয় সফরসঙ্গী হিসেবে ৩৮টি দেশ সফর করি। ‘৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারপ্রধান আমাদের সমর্থন দেন; সুযোগ-সুবিধামতো বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তন্মধ্যে ৩১ জন বিশ্বনেতার সাক্ষাৎকার সংবলিত ‘বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সাক্ষাৎকারের শেষাংশ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করছি। সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে ম্রিয়মাণ চিত্তে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের জীবন রক্ষায় চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুংকে আমি যে ফোন করেছিলাম, সেটা ছিল মানব জাতির পক্ষ থেকে বিশ্বনেতাদের দায়বদ্ধতা ও কর্তব্যবোধের অংশ। কিন্তু জাতিসংঘে যখন তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, তখন বিশ্বনেতাদের মধ্যে তাঁর মতো আর কাউকে আমি দেখেছি, তেমনটি মনে পড়ে না! তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি আমার থমকে গেছে। তাঁর দৃষ্টিতে স্বর্গীয় এক দ্যুতি ও শান্তির সম্মোহনী কিরণ ঝলমলিয়ে উঠত। আমি শেখ মুজিবকে আলিঙ্গন করেছিলাম ও গভীর প্রশান্ত চিত্তে শান্তি অনুভব করেছিলাম। আমি বলতে পারি যে, তাঁকে আমি খুব ভালোবেসেছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার আরও দেখা হবে এবং আমার সাধ ছিল প্রশান্ত চিত্তে তাঁর চোখ দুটি আরেকবার প্রত্যক্ষ করার- টু ওয়াচ সিম্ম্ফনি অব হেভেনলি রেইজ অব পিস ইনটু হিজ আই বল্‌স; তাঁর চোখে শান্তির সংগীতময় স্বর্গীয় রশ্মির অলৌকিক এক ঝিকিমিকি প্রতিভাত হতো, যা আমার খুব ভালো লাগত। আর কোনো বিশ্বনেতার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, এমন কারও চোখে যা আমি প্রত্যক্ষ করিনি। আমার মতো বহু বিশ্বনেতা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁর সাহচর্য উপভোগ করত এবং তাঁর সঙ্গে বারবার সাক্ষাৎ আশা করত। কিন্তু তোমাদের নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা আমাকে ও তাদের সবাইকে গভীর শোক ও বেদনায় নিমজ্জিত করে দেয়।’

১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে কানাডার অটোয়ায় কমনওয়েলথের এক মিটিংয়ে বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব মনোয়ারুল ইসলাম যোগ দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কার্যালয়ে যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত ছিলেন; কানাডার প্রধানমন্ত্রী তা অবহিত ছিলেন। তাঁকে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো ব্যক্তিগতভাবে বলেন, ‘তুমি দেশে ফিরেই এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলবে, তাঁকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তাঁকে আমার নাম করে বলবে সব ধরনের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে। তাঁকে জানাতে ভুলবে না যে, তাঁর জীবন ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। তাঁকে বলবে, তাঁকে আমি খুব ভালোবাসি। তাঁর চোখের পুণ্যময় ঝিকিমিকি আমার খুব ভালো লাগে। তাঁর চোখের দ্যুতিময় আলোকরশ্মির ঝলক আর কারও চোখে আমি দেখিনি।’

যুগ্ম সচিব মনোয়ারুল ইসলাম ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সতর্কবাণী ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুকে জানান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, ‘পুলিশ-আর্মির ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে আমার গরিব-দুঃখী মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকব; তারা এসে আমাকে একনজর দেখতে পাবে না- এমন জীবন আমি চাই না।’

লেখক : মুসা সাদিক – স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।


সর্বশেষ - রাজনীতি