২০০৭ সালের ১১ মে। বাংলাদেশে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন চলছিল। বিদেশিদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে সুরক্ষা বাহিনীর হাতে আটক হন তাসনিম খলিল। সাংবাদিকতার ছদ্মবেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার এজেন্ট হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব নষ্টের ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাকে আটক করা হয়। অবশ্য ভবিষ্যতে দেশাদ্রোহী কাজে যুক্ত না থাকার মুচলেকা দিয়ে ছাড়ান পান তিনি। এর অল্প কিছুদিন পর ৬ জুন দেশ ত্যাগ করেন তিনি। তারপর থেকে অ্যাসাইলাম নিয়ে সুইডেনে অবস্থান করছেন দেশাদ্রোহীতার অভিযোগে আটক এই ব্যক্তি। পরবর্তীতে খলিল নিজের লেখায় জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে নির্যাতন করেছিল গোয়েন্দা সদস্যরা। তাই দেশের সুরক্ষা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ তিনি।
যদিও ততদিনে দেশের সরকার বদলে গেছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ইউরোপে বসে উন্নত জীবনের প্রলোভন ছেড়ে আর দেশে ফেরেননি খলিল। উল্টো দেশের সরকার ও সেনাবাহিনী নিয়ে নিয়মিত কুৎসা রটনায় লিপ্ত হন। পরবর্তীতে ডেভিড বার্গম্যানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ২০১৯ সালে নেত্রনিউজ নামে একটি ওয়েবসাইট খোলেন। এ বছরের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খলিল জানান, মূলত আমেরিকার বেসরকারি সংস্থা এনইডি-এর অর্থায়নে এই ওয়েবসাইটটি খুলেছে। উন্নত গণতন্ত্রের পক্ষে প্রচারণার জন্য এনইডি অর্থায়নের কথা বললেও, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক কর্মকর্তাদের লেখা বই থেকে জানা যায়- এনইডি মূলত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ডা বাস্তবায়নে অর্থ লগ্নি করে। এদিকে নেত্রনিউজ এবং খলিলদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর নামে কুৎসা রচনা এবং গুজব ছড়াতেই ব্যস্ত তারা। এখানে এসেই আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে ডেভিড বার্গম্যানের উপস্থিতি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বার্গম্যান নিজেকে একজন সাংবাদিক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় জোটের সমন্বয়ক ও ধনকুবের ড. কামাল হোসেনের মেয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে বিয়ে করে ঘরজামাই হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান। এরপর শ্বশুরের প্রভাবে গণমাধ্যমে কাজ জোগাড় করে নিজের বেকারত্বের অবসান ঘটান তিনি। কিন্তু সাংবাদিকতার নৈতিকতা পরিপন্থী কার্যক্রমে যুক্ত থাকার দায়ে দুটি অফিস থেকে চাকরিচ্যুত হতে হয় তাকে। তাকে অপসারণের কারণ হিসেবে এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি তার সাবেক বস এবং বিডিনিউজের সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার ব্যাপারে একটি মন্তব্য করেছেন। বার্গম্যান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘২০১০ সালে ছয় মাস আমার অফিসে ছিল সে। তবে ডেভিডের এক ধরনের এজেন্ডা আছে, সেটা বোঝা যায় তার সাথে কাজ করলে। সাংবাদিকতার চেয়ে অ্যাক্টিভিজম বেশি।’
এদিকে ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হয় বাংলাদেশে। এই বিচারপ্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করতে নিয়মিত ব্লগিং শুরু করেন বার্গম্যান। এমনকি বার্গম্যানের বিতর্কিত মন্তব্য ও তার সরবরাহ করা তথ্য থেকে লিপিবদ্ধ একটি বইকে (ডেড রেকনিং) যুদ্ধাপরাদীদের পক্ষে সাফাই হিসেবে উপস্থাপন করে উগ্রবাদী দল বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিকৃত মন্তব্যের কারণে ২০১৪ সালে আদালত কর্তৃক সাজা ঘোষণা করা হয় বার্গম্যানের নামে। এরপর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন ব্রিটিশ জাত্যাভিমানি বার্গম্যান। কিন্তু ততদিনে স্ত্রী সারা হোসেনের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে তার সখ্যতা তৈরি হয়। বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকে বানচালের জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিতর্কিত লেখালেখির কাজ পান তিনি।
বার্গম্যান এখন নেত্রনিউজ নামক ওয়েবপোর্টালের সম্পাদক হিসেবে নিজেকে দাবি করেন। কিন্তু এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিবাদে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভ করতেও দেখা গেছে তাকে। এমনকি নিজেও তাদের পক্ষে এজেন্ডাভিত্তিক সংবাদ সরবরাহ করতেন দুটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তিনি খুন ও ধর্ষণের দায়ে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের বিশ্বগণমাধ্যমে ইসলামিক লিডার হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন তখন। এখনো দেশে সেই বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু এটি নিয়ে আর সোচ্চার নন বার্গম্যান। কারণ যেসব অভিযুক্ত তার শ্বশুরের রাজনৈতিক মিত্রদের তথা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, তাদের বিচার শেষ হয়ে গেছে। এরপর থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির পেছনে লেগেছেন ড. কামালের বেকার জামাই বার্গম্যান। উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বার্গম্যানের শ্বশুর ড. কামাল হোসেন যুদ্ধাপরাধীদের দলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যজোট গঠন করেছিলেন এবং জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু নির্বাচনে জিততে ব্যর্থ হয় তারা।
এরপরই শেখ হাসিনার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বার্গম্যান-খলিলকে দিয়ে খোলানো হয় নেত্রনিউজ নামক একটি পোর্টাল। খলিলের প্রয়োজন সুইডেনে বসে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত টাকা। আর বার্গম্যানের উদ্দেশ্য ড. কামালের পরামর্শ মতো ‘ইউক্রেন স্টাইলে’ সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে হঠকারিতার মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো। কিন্তু নিখুঁত সাংবাদিকতার বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকায়, তারা সফলভাবে প্রোপাগাণ্ডা ছড়াতেও ব্যর্থ হয়। উল্টো নিজেদের ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে আক্রমণাত্মক লেখালেখি করায় দাতাদের কাছেও তাদের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা নিয়ে ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্তু টাকায় টান পড়ার আগেই বিএনপি-জামায়াতের পক্ষ থেকে দেড়শ’ কোটি টাকার প্রকল্প পেয়ে যায় তারা। দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের এই টাকার জোগান দেন। ব্যারিস্টার সারা হোসেনের মধ্যস্থতায় তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয় তাদের। জামায়াত নেতাদের পরামর্শে বার্গম্যান ও খলিলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশবিরোধী গ্রাউন্ড তৈরির দায়িত্ব তারেক রহমান। এরপর থেকে সেই মিশন বাস্তবায়নের জন্য একজোট হয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই দুই ব্যক্তি। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকটিভিজম বাড়াতে তারা নিজেদের সঙ্গে নিয়েছে আরও কয়েকজনকে। ফলে নিজেদের এখনও অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলে দাবি করলেও, বিএনপি-জামায়াতের হয়ে তাদের অ্যাকটিভিজম প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।