ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: একটি বাঁকবদলের নির্বাচন এবং একজন নেতার নেতৃত্ব; দুটোই বাঙালি জীবনে ক্রান্তিকাল নির্দেশক ছিল। নির্বাচনটি পাকিস্তানে ১৯৭০-এর এবং এ নির্বাচনে বাঙালির ভাগ্যের ভবিষ্যৎ নির্দেশিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ছয় দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান হন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু। ’৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির বিজয়কে নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বের ভিতকে শক্ত করলেন। তিনি প্রমাণ করলেন, তিনিই শোষিত-নির্যাতিত বাঙালির মুখপাত্র, তিনিই বাঙালির কণ্ঠস্বর। ’৭০-এর নির্বাচন বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির জীবনে বাঁকবদলের ইঙ্গিতবহ ছিল।
’৭০-এর নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে তিন দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এক. বাঙালি পাকিস্তানি শাসনের নামে বৈষম্য ও শোষণের অবসান চেয়েছিল। সুতরাং নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান- বাঙালি আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। দুই. জনমতভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে সামরিক শাসনের ডায়ালেকটিকস এক ধরনের সিনথেসিস তৈরি করেছিল নির্বাচনের রায়ের মাধ্যমে। তিন. কিন্তু বিজয়ী জনমতভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে সামরিক জান্তার দ্বন্দ্বের ডায়ালেকটিকসের সিনথেসিস হলো বাঙালির স্বাধীনতার মাধ্যমে এবং যার অনুঘটক ছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং।
নির্বাচনের পটভূমি
১৯৬৯-এর ২৮ নভেম্বর পাকিস্তানের সামরিক জান্তাপ্রধান ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেন, ১৯৭০- সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; আর ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক তত্পরতার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারবে। ’৭০-এর জানুয়ারিতেই আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল প্রচারাভিযান শুরু করে। ১৮ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামী পল্টনে জনসভা করে। সভামঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়, ‘বাঙালিরা হিন্দুর গোলাম।’ তাত্ক্ষণিক উত্তেজনা, প্রতিক্রিয়া ও সংঘর্ষে তিনজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী আহত হয় পাঁচ শতাধিক। ঘটনাটি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ও নির্বাচনের পরিবেশে উত্তাপ ছড়ায়। অবশ্য এমন ঘোষণার মধ্য দিয়ে জামায়াত তার আসল চেহারা প্রকাশ করে, যার রুদ্রমূর্তি প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে।
অবশ্য জামায়াতি অপকর্ম সত্ত্বেও নির্বাচনী আবহাওয়া বেশ অনুকূল ছিল। কিন্তু আবহাওয়া প্রতিকূল হতে শুরু করে ৩০ মার্চ। সেদিন ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন আইনি কাঠামো আদেশ (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার)। আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ ও ওয়ালী ন্যাপ একসঙ্গে প্রতিবাদ করে। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সংগঠনগুলোও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এলএফওতে কী ছিল? ঘোষণাটির উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সংবিধানে ছয় দফা অন্তর্ভুক্ত করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সবসময়ই বলেছিল, ছয় দফার আলোকে পাকিস্তানের সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামো নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে। কিন্তু এলএফওর ২৫ ও ২৭ ধারা এমন নির্ধারিত লক্ষ্যের পথে বাগড়া দেয়।
নির্বাচনমুখী দল আওয়ামী লীগের ভেতর বিতর্ক শুরু হয় নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে। বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের একান্তে বলেছিলেন, ‘আমার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন শেষ হওয়ামাত্রই এলএফও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব।’ সামরিক গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো টেপ করে ইয়াহিয়াকে শোনালে তার তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘I will fix Sheikh Mujib if he betrays me.’ শেখ মুজিব প্রকারান্তরে ইয়াহিয়াকে betray করে বাঙালির স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন; কিন্তু ইয়াহিয়া তাকে fix করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু রেডিও-টেলিভিশনে নির্বাচনী ভাষণ দেন। ছয় দফা ও এগারো দফাভিত্তিক ছিল তার ভাষণ। ৫ নভেম্বর মওলানা ভাসানী ভাষণ দেন। কিন্তু ততদিনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে তার দলের ভেতর দোদুল্যমানতা প্রকাশ পেয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে এ নির্বাচনের তাত্পর্য নিয়ে মুসলীম লীগের খাজা খায়েরুদ্দীনের একটি দিকনির্দেশক মন্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি ঢাকার একটি আসনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। একটি জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘এ নির্বাচন হলো পাকিস্তান টিকবে কি টিকবে না তার ওপর গণভোট।’ বলা বাহুল্য, এ ব্যক্তি নির্বাচনের মর্মার্থ সঠিক অনুধাবন করেছিলেন; অন্তত পরবর্তী সময়ের ইতিহাস তা-ই বলে।
এদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে ১২ নভেম্বর হয়ে গেল এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়; হলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। মৃতের সংখ্যা ছিল ৫ থেকে ১০ লাখ। বিধ্বস্ত বাড়িঘরের কারণে বহু মানুষ হয়েছিল আশ্রয়হীন। কিন্তু ত্রাণকাজে সরকারি উদাসীনতা ছিল লক্ষণীয়। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সংগতকারণে ছিল তীব্র। মওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জন করে স্লোগান তুললেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। ভবিষ্যৎ তার দূরদর্শিতার সপক্ষে রায় দিয়েছিল। তিনি নির্বাচন না পিছিয়ে উপদ্রুত অঞ্চলে পরবর্তী সময়ে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন, যা গৃহীত হয়েছিল।
১৯৭০–এর নির্বাচন ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো
জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। প্রাদেশিক পরিষদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯ ডিসেম্বর। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের জলোচ্ছ্বাস-দুর্গত এলাকার আসনে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ২৪টি রাজনৈতিক দল এবং বেশকিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), ন্যাপ (ওয়ালী খান), মুসলিম লীগের বিভিন্ন গ্রুপ, জামায়াত-ই-ইসলামী, জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, জমিয়তে উলা’মা-ই-পাকিস্তান, নিজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ইত্যাদি।
নির্বাচনী ফলাফল
নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন (৭টি নারী আসনসহ) লাভ করে। বাকি দুটি আসনের মধ্যে একটি লাভ করে পিডিপি নেতা নুরুল আমীন এবং অন্য আসনটি লাভ করেন নির্দলীয় প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় চৌধুরী। জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এতে পশ্চিম পাকস্তানি শাসক চক্র বিপাকে পড়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ জাতীয় পরিষদে কোনো আসন পায়নি। জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসন লাভ করে ভুট্টোর পিপলস পার্টি। এছাড়া ছয়টি আসন পায় ন্যাপ (ওয়ালী খান), নয়টি মুসলিম লীগ (কাইউম খান), সাতটি মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), দুটি মুসলিম লীগ (কনভেনশন), সাতটি জমিয়তে উলামা-ই-পাকিস্তান, সাতটি জমিয়তে উলামা-ই-ইসলাম, চারটি জামায়াত-ই-ইসলামী এবং ১৩টি পায় নির্দলীয় প্রার্থী। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল—আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে ও পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে কোনো আসন লাভ করতে পারেনি। স্পষ্টতই এ নির্বাচন ছিল অঞ্চলভিত্তিক। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন লাভ করে। প্রদত্ত ভোটের ৮৯ শতাংশ পায় দলটি। বাকি ১২টি আসনের মধ্যে নয়টি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, দুটি পিডিপি এবং একটি জামায়াত-ই-ইসলামী। আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনসহ নির্বাচনে ৩১০টি আসনের মধ্যে মোট ২৯৮টি আসন লাভ করে।
আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় সাফল্যলাভের পেছনে কতগুলো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো—
১. ছয় দফা প্রস্তাব: আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছয় দফাভিত্তিক দাবি পূর্ব বাংলার জনসাধারণকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে নির্বাচনে জনসাধারণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে মূলত তাদের দাবির প্রতি সমর্থন দান করেছে।
২. বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি: জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে ছিলেন সংগ্রামী ও আপসহীন। আর এ কারণে ১৯৭০- এর অগ্নিগর্ভ সময়ে বাঙালি এক বাক্যে মুজিবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
৩. ভাসানীর নির্বাচন বর্জন: পূর্ব বাংলার একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ন্যাপ (ভাসানী) নির্বাচন বর্জন করেছিল ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগানে। কাজেই পূর্ব বাংলায় ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগের শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।
৪. মুসলিম লীগের জনবিচ্ছিন্নতা: ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে গণস্বার্থবিরোধী ভূমিকার কারণে দলটি পূর্ব বাংলায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নির্বাচনে মুসলিম লীগের অকল্পনীয় ভরাডুবি আওয়ামী লীগের বিজয়ের আরেকটি কারণ।
১৯৭০–এর নির্বাচনের গুরুত্ব
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭০-এর নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। এতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিপাকে পড়ে যায়। শেখ মুজিব তথা বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। নিম্নে ১৯৭০-এর নির্বাচনের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো—
১. নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয় হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই বিজয়।
২. জনগণ ছয় দফা প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের ছয় দফা থেকে সরে আসার পথ খোলা ছিল না।
৩. এ নির্বাচনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তান ভৌগোলিক কারণে কার্যত বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেননা পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার পাকিস্তানের দুই অংশে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।
’৭০-এর নির্বাচন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষা ছিল, যাতে তিনি পাস করেছেন সফলভাবে। তিনি যদি নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে অটল না থাকতেন তাহলে বাঙালির ভবিষ্যৎ অকল্পনীয় ছিল। এলএফও ও ঘূর্ণিঝড়সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টির কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল; আর এ সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় যে ঘটনাপ্রবাহ তার অনিবার্য পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)