নিজেকে কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, দার্শনিক, প্রেম ধর্মের নবী, মনোবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদসহ নানা বিশেষণে ভূষিত করা সিফাত উল্লাহ প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন আসিফ নজরুলকে হত্যার ঘোষণা দিয়ে। আসিফ নজরুল যখন জাহানারা ইমামের স্নেহের সুযোগ নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সংগৃহীত দুর্লভ ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল চুরি করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জামায়াতের কাছে বিক্রি করে তখন অনেকেই হতবিহব্বল হয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় আসিফ নজরুলকে হত্যার ঘোষণা দেয়ায় বহুদিন কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছিল সিফাত উল্লাহকে। বহুদিন নীরবতার পর ব্লগার হত্যার প্রতিবাদে ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আলোচিত হন, যদিও তার আরও আগে থেকেই সিফাত প্রচলিত ধর্ম ত্যাগ করে প্রকৃতির ধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এবার কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বিশেষত নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সিফাত উল্লাহ বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বলেই সকলের অভিমত। আর সেই প্রভাব চোখে পড়েছিল ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে। তার উক্তি ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে, ইউটিউবে ভিডিও ছাড়াও তার বক্তব্য নিয়ে গান তৈরি হয়। সিফাত উল্লাহর নাম অনলাইনের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলেও। বিপত্তি ঘটে এখানেই। একটি টিভি চ্যানেলে স্ত্রীর সাক্ষাতকার দেখার পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন সিফাত। বর্তমানে সত্তরোর্ধ এই আলোচিত অনলাইন ব্যক্তিত্ব অস্ট্রিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
কে এই সিফাত উল্লাহ?
সিফাত উল্লাহর বক্তব্য শুনে অনেকেরই তার সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা জন্মেছে, যেমন: অনেকের ধারণা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং এখনো এই পেশায় আছেন। প্রকৃতপক্ষে সিফাত উল্লাহ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে অধ্যয়ন করতেন। ছোটবেলা কেটেছে চাঁদপুরে। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন নি। জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কারাবরণ করতে হয়। এ সময় রিমান্ডে ইলেকট্র্রিক শক দেয়ার কারণে মানসিক বিপর্যয় ঘটে। কারাগার থেকে মুক্তির পর বহুদিন কাউকে চিনতে পারেন নি। দু বছর চিকিৎসাধীন থাকার পর টেলিভিশনের এক গায়িকার সাথে প্রণয় হয়। দু’জনে একটি এনজিওতে কাজ করতেন। কিন্তু এখানেও বিফল হন এবং বিয়ে করেন পরিবারের পছন্দের পাত্রীকে। ১৯৮৮ সালে ফ্রী ভিসায় সৌদি আরব যান এবং সেখান থেকে ১৯৯১ সালে এক বাংলাদেশীর সহায়তায় ভিয়েনা যান। ২০০০ সাল পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রি ও রেস্টুরেন্টে কাজ করেন ও জার্মান ভাষা শিখেন। এছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও রাজাকার বিরোধী আন্তর্জাতিক ফোরামে যুক্ত ছিলেন। অস্ট্রিয়ার টিভি চ্যানেলে প্রচারিত কয়েকটি সিরিয়ালে তিনি অভিনয় করেছিলেন। পোপের জীবন ভিত্তিক একটি ডকুমেন্টারীতে তিনি মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি পায়। এক বাংলাদেশী গৃহিনীকে উত্যক্ত করার অভিযোগে তাকে দেড় বছর কারাগারে থাকতে হয়েছিল। উগ্র মেজাজ এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের কারণে বাংলাদেশী কমিউনিটির কারও সাথেই তার সম্পর্ক নেই। বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভিয়েনায় রয়েছেন।
দেলোয়ার হোসেন সাইদী কোনো মসজিদে ঢুকলে সেই মসজিদ চল্লিশ দিন অপবিত্র থাকবে বলে মন্তব্য করেছিলেন সিফাত যা সকল মহলে প্রশংসিত হয়। আবার প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতাসহ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে সমালোচিতও হন। এছাড়া খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালে পাক বাহিনীর সাথে সম্পর্ক, জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার ইচ্ছা ও খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে কোকোর জন্ম নিয়েও তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ঠান্ডা মাথায় তিনি যা বলেন সেগুলো তার নিজের কথা এবং উত্তেজিত হয়ে যা বলেন তা তার নিজের কথা নয়। এ সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে গালিগালাজ করে মানসিক শান্তি পান তিনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দাবি করেছিলেন তিনি। ঐ সময় তিনি সকলকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানান। যদিও পরবর্তি ভিডিওতে আজীবনের জন্য শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার আহবান জানিয়েছিলেন। অনেকের ধারণা রাস্তায় নেমে আসা ও ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে প্রভাব ফেলেছিল, যে কারণে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে সিফাতের বক্তব্য দেখা গেছে। কিছু বিপথগামী ছাত্র তাদের বক্তব্যে ট্যাক্স না দেয়ার ও পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল।
আমাদের ভিয়েনা প্রতিনিধি জানান, সিফাত উল্লাহ বর্তমানে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। উচ্চ মানসিক চাপের কারণে তিনি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর এক প্রতিবেশী জানান টেলিভিশনে তার স্ত্রী নাহারের বক্তব্য দেখে অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়েন। “অশিক্ষিত, গরীব, মুর্খ, ছোটলোক, বেইমান, তোরা আমাকে ছোট করলি”, “, মিথ্যুক, ভণ্ড, প্রতারক, ধোকাবাজ আমার মুখ দেখানোর উপায় রাখলি না”, “তোদের দেশে আমার লাশও যাবে না” ইত্যাদি বলে কেঁদেছিলেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভিয়েনা প্রবাসী বলেন, আমরা তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে ভিডিওতে তার কষ্ট আড়াল করার প্রাণপন চেষ্টা দেখি। আবেগপ্রবণ হয়ে গেলে শিশুদের মত খেলনা নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখি। এখনো তার ঘরে বাঁধানো রয়েছে প্রথম প্রেমিকার ছবি। মাসে যে ভাতা পান সেখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে দেশের অনেক প্রিয় মানুষের কাছে বেনামে উপহার পাঠান। মাস ছয়েক আগেও এক গরীব মেয়ের বিয়ের খরচ জোগাতে এক মাস ফুল বিক্রি করেছেন। অনলাইনে পরিচয়ের সুবাদে পরীক্ষার ফী বা বই কেনার টাকা দিয়েছেন অগণিত মানুষকে। আবার অনেকে ধোঁকা দিয়েও তার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই মানুষটিকে না পারি ভালোবাসতে না পারি ঘৃণা করতে।