আমার শৈশবকালে জনপ্রিয় শ্যামাসংগীতশিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের একটি গান প্রায় সব মানুষের মুখে মুখে বিরাজ করত। গানটির প্রথম লাইন হলো ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা।’ পরের একটি লাইনে করুণা ভিক্ষার আর্তনাদ, যা হলো ‘কোলে তুলে নিতে আয় মা।’ অর্থাৎ সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোনো ব্যক্তি যখন সর্বস্বান্ত, তখন কোলে তুলে নেওয়ার অনুরোধ করা ছাড়া তার আর কিছু থাকে না।
সেদিন এক দুর্মুখ ব্যক্তি এসে বললেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নাকি এখন পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেই গানটি শুনে শুনেই দিন কাটাচ্ছেন। মির্জা ফখরুল সংগীত রসিক কি না জানি না। তবে বেশ কয়েক বছর আগে এক অনুষ্ঠানে তাঁর মুখে কবিগুরুর ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’ কবিতার আবৃত্তি শুনে অবাক হয়েছিলাম এ জন্য যে বিএনপির মতো সাম্প্রদায়িক দলের, যে দল ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না, সেই দলের নেতার মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা—সে তো অবাক করার মতোই। তাঁদের নেত্রী তো পরিষ্কার ভাষায় রবীন্দ্রবিরোধী কথা বলতেন, হয়তো রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনা পড়ার সুযোগ তাঁর কখনো হয়নি।
যা হোক, সেই দুর্মুখ ব্যক্তিকে মির্জা ফখরুলের এই বিশেষ গানটির প্রতি আকর্ষণের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া যেভাবে মির্জা ফখরুলদের সাজানো গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিলেন, তারপর আর তাঁর কী করার আছে? তাঁর কথা শুনে কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি গানও মনে পড়ল, গানের কথা হলো, ‘আমার জীবনের এত হাসি এত খুশি কোথায় গেল?’ সেই সঙ্গে সুবীর সেনের গানটিও মনে পড়ল, যার প্রথম লাইন, ‘এত সুর আর এত গান যদি কোনো দিন থেমে যায়।’
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারবেন না জেনে মির্জা ফখরুল ও তাঁর দলের অন্যরা ধরে নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্ণধাররা শেখ হাসিনা তথা আওয়ামীবিরোধী হওয়ায় তাঁদের হাত ধরে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব! ১৭৫৭ সালে মীরজাফর গং একই ধারণার বশবর্তী হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির রবার্ট ক্লাইভের কাঁধে ভর করে বাংলার মসনদ দখল করতে চেয়ে তারপর কী পেয়েছিলেন, তা কারো অজানা নয়। মীরজাফর ও মির্জা ফখরুলের নামে মিল রয়েছে বিধায় তাঁদের চিন্তায় মিল থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। আমেরিকা তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে ভেবে তাঁদের দৌড়ঝাঁপের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
বাংলাদেশবিরোধী কথায় ভরপুর বহু চিঠি তাঁরা ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রশাসনের কাছেও পাঠাতে থাকেন, ঠিক যেমনটি মীরজাফর গং কাশিমবাজার কুঠিতে ধরনা দিয়ে করছিলেন। মার্কিন সরকার এবং দূতাবাসের কিছু কর্মকাণ্ডকে তাঁরা নির্ভুলভাবে অনুধাবন করতে না পারায় তাঁদের দুরাশা তথা দিবাস্বপ্ন আরো বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত করার জন্যই এই নীতি গ্রহণ করেছে। তাঁদের এই ধারণা ছিল আত্মপ্রতারণারই শামিল। তাঁরা এটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে মার্কিন ভিসানীতির বিষফল তাঁদেরই ভক্ষণ করতে হবে।
কেননা তাঁরাই নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত।
ঢাকায় প্রতিনিয়ত মার্কিন কর্মকর্তাদের আগমনকেও তাঁরা হাসিনা সরকারের অপসারণের প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে বোকার স্বর্গে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে মোদি-বাইডেন একান্ত বৈঠকের পর আত্মতৃপ্তি প্রসারের জন্য তাঁরা বলতে এবং লিখতে শুরু করলেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তোলেননি। ভাবটা এই যে মোদি-বাইডেন একান্ত বৈঠকে, যেখানে আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না, যেন তাঁদের কেউ উপস্থিত ছিলেন অথবা তাঁরা এমন কোনো ডিভাইস বসিয়েছিলেন, যার দ্বারা মোদি-বাইডেন আলোচনা শোনা যায়। এরপর খবর এলো মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া ঢাকায় আসবেন। এ খবরে মির্জা গং যেন চাঁদে পৌঁছানোর মতোই পুলকিত হয়েছিলেন। নিশ্চিত হয়েছিলেন এই আজরা জেয়াই শেখ হাসিনা সরকার খতম করে দেবেন। তাঁদের সেই দুরাশার মরীচিকায় তখনই ধস নামল, যখন দেখা গেল আজরা জেয়া বিএনপির কারো সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না, যেই প্রত্যাশায় তাঁদের বুকের মাপ বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। আজরার সঙ্গে বৈঠক করার চেষ্টায় তারা স্বর্গ-নরক এক করেছিলেন। এমনকি কানাডার রাষ্ট্রদূতেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। মির্জা ফখরুল গংয়ের মাথায় আরো কঠিন বাজ পড়ল, যখন জানা গেল যে আজরা জেয়া বিএনপির তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির কথা উল্লেখই করেননি। তিনি শুধু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় এবং আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়া সে দেশই ঠিক করবে, এতে বিদেশিদের ভূমিকা থাকতে পারে না। পরবর্তী সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিও মিলারও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সফরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, আলোচনা হয় সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে।
মির্জা ফখরুল গং এটা বুঝতে পারেননি যে আজরা জেয়ার ঢাকা সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরকে সব দেশের অবাধ নৌ চলাচলের নিশ্চয়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল তৈরি করা হয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ করা। কেননা ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের ভূমিকা অপরিহার্য। একই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকা আসার আগে দিল্লি গিয়েছিলেন। এটা ঠিক যে তাঁর আলোচ্যসূচিতে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রসঙ্গও ছিল। কিন্তু সেটি আদৌ মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল না, ছিল আলোচ্যসূচির নিচের পর্যায়ে। আজরা জেয়া ঢাকা আসার দু-এক দিন আগেই সম্ভবত মির্জা ফখরুল গং টের পেয়েছিলেন যে তাঁরা যা ভাবছেন, তা হতে যাচ্ছে না। এটা ভাবার বড় কারণ ছিল বিএনপিকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ না জানানো। মির্জা ফখরুলের মুখে তখনই ভিন্ন কথা শোনা যায়। বললেন, মার্কিন দলের কথা এবং গতিবিধি অনুসরণ করেই বিএনপি তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে। একটি সার্বভৌম দেশের রাজনৈতিক দলের এক নেতার থেকে এ ধরনের কথা, যার অর্থ বিদেশিদের হাতে দেশের ভবিষ্যতের ভার ছেড়ে দেওয়া শুধু পীড়াদায়কই নয়, গর্হিতও বটে। আজরা জেয়ার প্রস্থানের পর মির্জা ফখরুল গংয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। তাঁরা বাস্তব জগতে ফিরে বলেছিলেন, বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না, তাঁদের পন্থা তাঁরাই নির্ধারণ করবেন। তাঁর কথায় মনে হলো মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের আত্মবিলাপ নামের অমর কবিতাটির কথা, যাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়।’ মাইকেলের মতো বিরল এবং অসাধারণ প্রজ্ঞা ও প্রতিভার অধিকারী মানুষ, যিনি ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের রচয়িতা, তিনিও শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করেছিলেন, দুরাশার মরীচিকার পেছনে ঘোরার চেয়ে বোকামি কিছু নেই। তিনি সেই বাণীই দিয়ে গেছেন মির্জা ফখরুলের মতো রাজনীতিবিদদের জন্য। কিন্তু তাঁরা মাইকেলের বাণী অনুধাবন করতে অক্ষম বলেই এখন বিমাতার কাছে কান্না করছেন কোলে তুলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁদের কোলে তুলে নেওয়ার যে কেউ নেই। হারাধনের ছেলেদের মতো তাঁদের কান্না চলতেই থাকবে।
লেখক: বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক – আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।