1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

জামায়াত, জঙ্গিবাদ ও আমেরিকা

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
শনিবার, ২২ জুলাই, ২০২৩

গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে, ‘সন্তানের জন্য মায়ের চেয়ে যার বেশি দরদ, তাকে বলে ডাইনি’। আমেরিকা কী বাংলাদেশে এখন ‘জামায়াতে ইসলামী’র জন্য ডাইনির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো? মানবাধিকারের নামে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী জামায়াতে ইসলামীকে তুষ্ট করার আমেরিকার রাজনীতির ত্রিকোণমিতি সম্পর্কিত এই প্রশ্নটি একটু খুলে বলাই ভালো।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর ছেলে সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী ২০১৩ সালে এসেছিলেন বাংলাদেশে, একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে। তখন তিনি অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী ‘‘জারজ সন্তান’’। জারজ সন্তানের যেমন পৈত্রিক সম্পত্তিতে কোনো অধিকার থাকে না, তেমনি জামায়াতে ইসলামীরও বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই।’ স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতার পুত্র এই দাবি করলেও রাজনীতির ত্রিকোণমিতির ক্যারিশমায় সাত সমুদ্দুর তের নদীর পাড়ে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু সর্বশক্তি নিয়ে এই জারজ সন্তানের পিতার পরিচয় দিতে এগিয়ে এসেছে!

ত্রিকোণমিতি গণিতের একটি শাখা, যাতে ত্রিভুজের কোণ, বাহু ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যবহার করে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জামায়াতে ইসলাম এবং বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পর্কে কী সেই ত্রিকোণমিতি তৈরি হচ্ছে? হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি হচ্ছে জামায়াতে ইসলামের সৃষ্টির ভিত্তি। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ৭১’র গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানির কারণে বাংলাদেশের বৃহত্তম মুসলিম রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সদস্যবৃন্দ তাদের সংবিধান প্রদত্ত বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছেন না।’ এবং ‘সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের কারণে জামায়াত প্রার্থীরা দলের নামে নির্বাচন করতে পারছেন না’ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন এই বিবৃতিতে যে মন্তব্য করা হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষদের বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। জামায়াত সম্পর্কে মার্কিন বিবৃতি অত্যন্ত নিন্দনীয়। জামায়াত সম্পর্কে অত্যন্ত নিন্দনীয় মার্কিন প্রতিবেদন শুধু অসত্য নয়, এটি বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশে জামায়াত পরিচালিত জঙ্গি মৌলবাদী সন্ত্রাসকে ইন্ধন জোগাতে সাহায্য করবে। এ সম্পর্কে ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ সময়োপযোগী এবং উপযুক্ত একটি বিবৃতি দিয়েছে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।

জামায়াত একটি গণতন্ত্রবিরোধী ফ্যাসিস্ট দল। যারা বাংলাদেশের সংবিধান মানে না। এ কারণে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ২০১৩ সালে এ দলের নিবন্ধন বাতিল করেছে, যার ফলে দলীয় পরিচয়ে জামায়াতের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। সরকার কখনো জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেনি। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে ৭১’র গণহত্যার জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করা হয়েছে। জামায়াত মানবরচিত সংবিধানে বিশ্বাস করে না। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণে ঘোষিত গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকে প্রত্যাখ্যান করে ৮০ বছর আগে লিখেছিলেন– ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি কুফরি মতবাদ। যারা এসব মতবাদ প্রচার করবে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।’

এ ধরনের গণতন্ত্রবিদ্বেষী ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামীকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী দল হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার জন্য যে ওকালতি করছে তাতে উপমহাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে ইসলামের নামে যাবতীয় সন্ত্রাসের গুরু জামায়াত শুধু অধিকতর সন্ত্রাসী কার্যক্রমে উৎসাহিত হবে না, ভবিষ্যতে আমেরিকার মতো দেশে ৯/১১-এর মতো অসংখ্য সন্ত্রাসী ঘটনায় ইন্ধন জোগাবে।

২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাঙ্কস জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে হাউস রেজোলিউশন ১১৫৬ জমা দিয়েছিলেন, যেখানে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ইউএসএইডকে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে– জামায়াত-শিবিরসহ সমমনা দলগুলোকে যেন কোনোরকম প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। এতে আরও বলা হয়েছে– ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে ৩০ লাখ মৃত্যু, প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী ধর্ষণ এবং ১ কোটি মানুষের দেশান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশের সঙ্গে জামায়াতের জঙ্গিরা জড়িত।

মার্কিন আইনপ্রণেতার এই বিলে আরও বলা হয়েছে– বিগত নির্বাচনগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের হামলার শিকার হয়েছে, যার ফলে নভেম্বর ২০১৩ থেকে জানুয়ারি ২০১৪ এর ভেতর ৪৯৫টি হিন্দু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৫৮৫টি দোকান আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে এবং ১৬৯টি মন্দির ধ্বংস হয়েছে।

জিম ব্যাঙ্কসের এই বিলকে স্বাগত জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘মিডলইস্ট ফোরাম’ বলেছে, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি ভয়ংকর প্রভাবশালী গোষ্ঠী, যাদের সন্ত্রাসের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।’

উল্লেখ্য, বিএনপির জোটে থেকে এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রশ্রয় পেয়ে জামায়াত এখনো তাদের আশ্রিত জঙ্গি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।

কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাঙ্কস ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে হাডসন ইনস্টিটিউটে ‘বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র এবং ইসলামবাদ’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে একটি ক্রমবর্ধমান গণতান্ত্রিক দেশ যার বৈশ্বিক মঞ্চে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি রয়েছে।’ ব্যাঙ্কস বলেছেন, ‘তবে জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামপন্থি দলগুলো দেশের সমৃদ্ধির জন্য হুমকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এই উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা।’

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ৩১ বছর ধরে ৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংবিধানবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার জন্য আন্দোলন করে আসছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট যদি বাংলাদেশসহ মার্কিন জনমত উপেক্ষা করে জামায়াত তোষণ নীতিতে অবিচল থাকে, তা শুধু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে বিপন্ন করবে না, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও তা সমূহ বিপদ ডেকে আনবে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০১৩ সালে ‘ধর্ম ও রাজনীতি : দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক দুই দিনের আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মিলনী অনুষ্ঠানের শেষ দিনে কথা বলতে গিয়ে জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর পুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন, যে দল এ দেশের জন্মে বিশ্বাস করে না, এ দেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে না, সে দল এ দেশে রাজনীতি করে কীভাবে? তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। তিনি মনে করেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলো যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধিতা করেছে, তাই বাংলাদেশে কোনো ধর্মভিত্তিক দলকে রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল– স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধকরণ। ওই সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল হিসেবে পাঁচটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সে দলগুলো ছিল– জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজাম-ই-ইসলামী এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাই করেনি, পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা এবং যুদ্ধাপরাধ করেছে। অবশ্য ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন।

পাকিস্তানের নাগরিক সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী ১৯৪১ সালে ইসলাম ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার নয় সন্তানের কেউ এ রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। শুধু তাই নয়, আবুল আলা মওদুদী নিজে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠা করলেও তার সন্তানদের তিনি তার সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের অনুসারী হতে নিষেধ করে যান। ফলে তার সন্তানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তারা কেউ পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে জড়িত নয়।

হায়দার ফারুক মওদুদী ধর্ম প্রসঙ্গে বলেন, ধর্ম আমাদের ভালো হওয়ার নৈতিক শিক্ষা দেয়। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ– প্রত্যেক ধর্ম তার বিশ্বাসীদের ভালো হওয়ার শিক্ষা দেয়। ধর্ম আমাদের আরও শিক্ষা দেয়, আমাদের পূর্ব পুরুষ এক এবং কোনো ধর্মের মানুষকে আমাদের ঘৃণা করা উচিত নয়। জামায়াত ইসলামী প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করার শিক্ষা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এখন সেই ঘৃণা সৃষ্টিকারী বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামীকে অবাধে ঘৃণা ও জঙ্গিবাদী রাজনীতি করার সুযোগ করে দিতে চায়? এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলার মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী – পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ - রাজনীতি