1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

নুর ব্যতিক্রম নন; সাধারণ ধান্ধাবাজ, চান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতামাত্র!

প্রভাষ আমিন : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৩

পাশাপাশি দুই গ্রামের মধ্যে সব বিষয় নিয়ে রেষারেষি। দুই গ্রামে দুটি স্কুলও আছে। একবার ঠিক হলো, দুই গ্রামের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দেবেন দুই স্কুলের শিক্ষক। প্রতিযোগিতার নিয়ম হলো, এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে প্রশ্ন করবেন। যার উত্তর ভুল হবে, তিনি হেরে যাবেন। প্রথম শিক্ষক শুরুতেই প্রশ্ন করলেন, বলুন তো ‘I don’t know’ অর্থ কী? প্রতিপক্ষের শিক্ষক চিৎকার করে বললেন, ‘আমি জানি না।’ ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম শিক্ষকের গ্রামের লোকজন হৈহৈ করে উঠলেন, জানে না, জানে না। সঠিক উত্তর দিয়েও হেরে গিয়েছিলেন প্রতিপক্ষ শিক্ষক। ২০১৮ সালে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল তেমনই একটির ওপর চালাকি আন্দোলন। কোটার মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, এমন একটি ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে ছাত্রসমাজকে ক্ষুব্ধ করা হয়েছে। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে সেই বৈষম্য দূর করারই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পিছিয়ে পড়া মানুষদের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতেই বিভিন্ন দেশে কোটা পদ্ধতি রয়েছে। কোনো সভ্য দেশ কোটামুক্ত থাকতে পারে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল টার্গেট অবশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ। ছাত্র অধিকার পরিষদ সুকৌশলে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে খেপিয়ে তুলেছিল। শরীরে ‘আমি রাজাকার’ লিখে মাঠে নামার ঔদ্ধত্য কোটা আন্দোলনের কর্মীরাই দেখিয়েছিল। নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা সাফল্যের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের আবেগ প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।

তবে জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ছাত্র অধিকার পরিষদ সাফল্য পেয়েছিল। বাংলাদেশ এখন কোটামুক্ত। এই আন্দোলনে আর কার কী লাভ হয়েছে জানি না, তবে নুরুল হক নুর নেতা হয়েছেন। আর তাকে নেতা বানানোর কৃতিত্ব পুরোটাই ছাত্রলীগের। তাকে বারবার মেরে মেরে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা, ডাকসুর ভিপি এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয় নেতা বানিয়েছে ছাত্রলীগ। আমি কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে না থাকলেও তাদের আন্দোলন করার অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল। ছাত্র অধিকার পরিষদ বা কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীর ওপর পুলিশ বা ছাত্রলীগের হামলার নিন্দা জানিয়েছি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাফল্যের পথ ধরে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে জন্ম নেয় নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গণঅধিকার পরিষদ। তাদের রাজনীতির প্রতি সমর্থন না থাকলেও তাদের রাজনীতি করার অধিকারের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল, আছে এবং থাকবে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সব দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করার, রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

ছাত্র অধিকার পরিষদ শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুললেও শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলন থেকে নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন নুরুল হক নুর। তিনিই ছাত্র অধিকার পরিষদের মূল নেতা, তিনিই গণঅধিকার পরিষদের মূল নেতা। নুরুল হক নুরের একটা বড় গুণ হলো অনমনীয়তা। এটা করেই তিনি সবার নজর কেড়েছেন। বারবার ছাত্রলীগের মার খেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থেকে দাবি আদায় করে ছেড়েছেন। এই অনমনীয়তা, দাবি আদায়ে আপসহীনতা তাকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তার চেয়ে বড় কথা গ্রাম থেকে উঠে আসা নুরুল হক নুরের মধ্যে এক ধরনের সারল্য ছিল। তার চলনে, বলনে, পরনে, আচরণে এক ধরনের মাটির গন্ধ ছিল। চতুর রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়ে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন নুর। তরুণরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও তাকে পছন্দ করতে শুরু করে। ডাকসুর ভিপি হওয়ার পর গণভবনে গিয়ে নিজেকে ছাত্রলীগ এবং শেখ হাসিনার মুখে তার মায়ের ছবি দেখার দাবি করলেও নুরুল হক নুর শেষ পর্যন্ত প্রবল সরকারবিরোধী অবস্থান নেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে কার্যকর বিরোধী দল বা বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের খরার কালে নুর আসলেন একপশলা বৃষ্টি হয়ে। তাকে নিয়ে অনেকেই বড় স্বপ্নও দেখতে থাকেন। তার অসম সাহস, সরকারবিরোধী দৃঢ় অবস্থান অনেককেই আশাবাদী করে। কিন্তু নুরুল হক নুর প্রমাণ করেছেন তিনি ব্যতিক্রম কেউ নন, আর দশজনের মতো সাধারণ ধান্ধাবাজ, চান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতামাত্র। গ্রামের সহজ-সরল নুর দ্রুতই বদলে গেলেন একজন ধূর্ত রাজনৈতিক চরিত্রে।

তাকে নিয়ে ফিসফাস ছিল আগেই। বিভিন্ন দূতাবাসে তার রহস্যজনক যাতায়াত, দল চালানোর ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। কিন্তু দুবাইয়ে ইসরায়েলের নাগরিক রহস্যজনক চরিত্র মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের ছবি প্রকাশের পর বিতর্কের ঝড় ওঠে। তিনি অবশ্য বারবার অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। কিন্তু যখন তার দলের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া অভিযোগটি তুললেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে, তখন আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। ড. রেজা কিবরিয়া সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, কবে, কাদের সঙ্গে নুর সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করতে গেছেন, কারা তাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছেন, বৈঠক থেকে ফেরার পথে কালো ব্যাগ নিয়ে এসেছেন, তাও বলেছেন। রেজা কিবরিয়ার অভিযোগের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত দাবি করেছেন, একবার নয়, নুরের সঙ্গে সাফাদির বৈঠক হয়েছে অন্তত তিনবার। স্বয়ং মেন্দি এন সাফাদিও জানিয়েছেন, নুরের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। এত অকাট্য প্রমাণের পরও নুর কিন্তু সেই অস্বীকারের পথেই হাঁটছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর বছরের পর বছর নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে ইসরায়েল মানেই ঘৃণিত। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অনেক দেশের মানুষের সঙ্গেই আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ আছে। কিন্তু সেই তালিকায় ইসরায়েল নেই। এই বিতর্কিত মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করার দায়ে কারাভোগ করেছেন বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী। এতকিছু জেনেও নুর কেন তার সঙ্গে বৈঠক করতে গেলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা দেবেন কী, নুর তো স্বীকারই করেননি। নুর যদি সাক্ষাতের বিষয়টি স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতেন, তাহলে জল এতদূর গড়াত না। শুধু ইসরায়েলের নাগরিক নয়, ভারতের গোয়েন্দাদের সঙ্গেও তার যোগাযোগের অভিযোগ আছে। এক টকশোতে নুর বলেছেন, বর্তমান সরকারকে হটাতে প্রয়োজনে ষড়যন্ত্র করতেও তার আপত্তি নেই। সব মিলিয়ে গ্রামের সহজ-সরল নুর এখন বাংলাদেশের রাজনীতির এক সন্দেহজনক চরিত্র।

নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে তার চেয়েও বড় অভিযোগ হলো, আর্থিক অস্বচ্ছতা। রাজনীতি করতে, দল চালাতে টাকা লাগে। বিভিন্ন দল শুভাকাঙ্ক্ষীদের চাঁদায় চলে। এটা ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সেই টাকার হিসাব রাখা, স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় করা, জবাবদিহি নিশ্চিত করাটা জরুরি। এখানেই আটকে গেছেন নুর। নিন্দুকরা আগে থেকেই নুরকে ‘বিকাশ নুর’ বলে ডাকত। বিকাশে চাঁদা নিয়েই নাকি চলতেন তিনি। কিন্তু ড. রেজা কিবরিয়ার অভিযোগ আরও বড়। প্রবাসীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আনলেও তার কোনো হিসাব নেই। হিসাব চাইতে গিয়েই পদ হারিয়েছেন ড. রেজা কিবরিয়া। নুরুল হক নুর রাজনৈতিক দল করার সময় ক্লিন ইমেজের রেজা কিবরিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন দলের আহ্বায়ক হিসেবে। কিন্তু নিজের নিয়োগ করা আহ্বায়ক যে তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, এটা হয়তো ভাবেনইনি নুর। শেষ পর্যন্ত গণঅধিকার পরিষদও বাংলাদেশের আর দশটা রাজনৈতিক দলের মতো ব্যক্তিনির্ভর। গণঅধিকার পরিষদও নুরুল হক নুরেরই দল। তাই তো আহ্বায়ককে বহিষ্কার করে দেন সদস্য সচিব। তবে এবার বোধহয় নুর সহজে পার পাবেন না। ড. রেজা কিবরিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন নুরের দীর্ঘদিনের সহযাত্রীদের অনেকেও।

চাঁদাবাজির কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হাজির করা মুশকিল। কিন্তু সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের আন্দোলন করা এবং সফল হওয়া ছাত্র অধিকার পরিষদের কেউ কিন্তু সরকারি চাকরিতে যাননি। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াই নুর এবং তার সহকর্মীরা বছরের পর বছর সচ্ছল জীবনযাপন করছেন। নুররা আবার প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতির চেয়ে লাভজনক কোনো পেশা নেই। গ্রামের কৃষকের ছেলে নুরুল হক নুর কিছু না করেও এখন অভিজাত জীবনযাপন করেন, দামি গাড়িতে চড়েন। শুধু নুর নয়, তার দুই ভাই, শ্যালকের কপালও খুলে গেছে। সবাই এখন সচ্ছল ব্যবসায়ী। তারা কোন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের দেখা পেলেন, কে জানে।

তারুণ্যের অহংকার হয়ে রাজনীতিতে পা রাখা নুরুল হক নুর এখন তারুণ্যের দায়। তুমুল আশা জাগানো নুর এখন এক হতাশার নাম। আলো ছড়াতে আসা নুর রাজনীতিতে অন্ধকারই ছড়াতে পেরেছেন শুধু।

লেখক : প্রভাষ আমিন – হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ


সর্বশেষ - রাজনীতি