আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশের উত্তরাঞ্চলে আকস্মিক বন্যাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় আছে। তাই এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
মানুষের জীবনধারণের জন্য মাটি, পানি, বায়ু ও খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে।
আমরা সব কিছুতেই উন্নত দেশকে অনুকরণ করতে চাই। কিন্তু যে বিষয়গুলো অনুকরণ করলে আরো উন্নত হওয়া যায়, সেগুলো না করে উন্নত বিশ্বের ধসে পড়া পারিবারিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ অনুকরণ করছি কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। আমাদের উচিত সেই বিষয়গুলো অনুকরণ করা, যা আমাদের উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। অস্ট্রেলিয়ায় পানির সাশ্রয়ী ব্যবহারে গাড়ি ধোয়ার জন্য নির্দিষ্ট দিন আছে। অর্থাৎ যেকোনো দিন ইচ্ছা করলেই গাড়ি ধোয়া যাবে না। আবার গাছ কাটতে হলে সরকারের অনুমতি নেওয়ার পরই কেবল কাটা সম্ভব। খাবারকে তারা সমাজের সম্পদ মনে করে। বিশ্বের অনেক মানুষের সম্পদের অভাব রয়েছে। সুতরাং তাদের দেশে সম্পদ নষ্ট করার কোনো অধিকার কারো নেই—এটাই তাদের বক্তব্য।
ভারতেও অপচয় করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি ভ্রমণে গিয়ে দেখেন, সব ক্ষেত্রেই তারা আপনাকে মিতব্যয়িতা শেখাবে। সব কিছুতেই হিসাব করে খরচ করা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যাস। সেই অভ্যাসবশতই হয়তো আপনাকেও এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে দেবে। আপনি যদি কোনো চীনা নাগরিকের সঙ্গে কাজ করেন, দেখবেন তারা কতটা মিতব্যয়ী। যে তিনটি জাতির কথা বলা হলো, তারা বিশ্বের প্রভাবশালী জাতি হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।
মিতব্যয়ী ব্যক্তি তার ব্যক্তিজীবনে কখনোই অর্থকষ্টে পড়ে না। সে সব সময়ই একটি সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজের জীবন অতিবাহিত করে। সব থেকে বড় কথা, নিজের জীবন চালানোর জন্য অন্যের কাছে তার হাত পাতার দরকার হয় না। কিন্তু বেহিসাবি মানুষের জীবনে অর্থকষ্টে পড়ার আশঙ্কা থাকে এবং হিসাবের বাইরে খরচ করার জন্য তার অবৈধ আয়ের উৎসর প্রতি মনোযোগ আসতে পারে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি যে নাজুক হয়ে পড়েছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র কয়েক ঘণ্টা করে লোড শেডিং চালাতে হচ্ছে। আপাতত লোড শেডিং মেনে নেওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু এই বিড়ম্বনার বণ্টন হতে হবে ‘ন্যায্যতার ভিত্তিতে’। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী পদক্ষেপের বিকল্প নেই।
মনে রাখতে হবে, চলমান বিদ্যুৎসংকটের মূল কারণ উৎপাদন ও সঞ্চালন ব্যবস্থা নয়। গ্যাস ও তেল সরবরাহে টান পড়ায়ই এমন পরিস্থিতি। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে স্বাভাবিক সরবরাহের তুলনায় অন্তত ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আর গ্যাস সরবরাহে টান পড়ার মূলে রয়েছে ইউক্রেন সংকট। বিশ্ববাজারে গ্যাসসহ জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজারে এলএনজি বা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সুলভ নয়। এদিকে অভ্যন্তরীণ গ্যাসের উৎসগুলোতে উৎপাদন আগে থেকেই কমছে। একসময় দেশ ‘গ্যাসের ওপর ভাসছে’ দাবি করা হলেও কয়েক বছর ধরে ক্রমেই কমছে গ্যাসের উৎপাদন। কাজেই গ্যাসেও আমদের সাশ্রয়ী হতে হবে।
সরকারি স্থাপনা, পরিবহন, শিল্প খাত ছাড়াও নাগরিকদের বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হতে হবে। আমরা অনেক সময় একটি বাল্ব অপ্রয়োজনে জ্বালিয়ে রেখে মনে করি, বেশি অপচয় হচ্ছে না। কিন্তু কমবেশি ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে এভাবে পরিবারপ্রতি একটি বৈদ্যুতিক বাতিও যদি অপ্রয়োজনে জ্বালানো থাকে, তা স্বল্প জনসংখ্যার অনেক দেশের মোট বিদ্যুৎ ভোগের সমান হতে পারে। বৈদ্যুতিক বাতি তো নেহাত ‘তুচ্ছ’ বিষয়; নাগরিকরা অপ্রয়োজনে ফ্যান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ বৈদ্যুতিক গৃহস্থালি প্রযুক্তিও যেভাবে অপ্রয়োজনে ব্যবহার করে, তা যেকোনো বিবেচনায়ই অপচয়মূলক। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কাঁচামাল গ্যাস যেভাবে ব্যক্তিগত গাড়িতে নির্বিচারে পোড়ানো হয়, তা নিয়েও দীর্ঘ মেয়াদে ভাবার সময় এসেছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি খাত, বিশেষ করে তেল ও গ্যাসের যে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে তার ধাক্কা লেগেছে বিশ্বের সর্বত্র। তেলের পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম একলাফে আকাশচুম্বী হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের বিকল্প হিসেবে পশ্চিমারা উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে নিজেদের ঘাটতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের তুলনায় পশ্চিমাদের সেই সক্ষমতা একটু বেশিই আছে। তার পরও আসছে শীতে পরিস্থিতি কতটুকু সামাল দেওয়া যাবে সেই আশঙ্কা থেকেই যায়। জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে আবার ফুলেফেঁপে উঠছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ ও কম্পানিগুলো। বেশ কিছুদিন ধরেই যুদ্ধের হাত ধরে একদিকে লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, অন্যদিকে ক্রমে ক্রমে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা যেন ধীরে ধীরে সত্যি হতে যাচ্ছে। তাই সব ক্ষেত্রেই সাশ্রয়ী হতে হবে।
লেখক : হীরেন পণ্ডিত – প্রাবন্ধিক ও গবেষক।