1. অন্যরকম
  2. অপরাধ বার্তা
  3. অভিমত
  4. আন্তর্জাতিক সংবাদ
  5. ইতিহাস
  6. এডিটরস' পিক
  7. খেলাধুলা
  8. জাতীয় সংবাদ
  9. টেকসই উন্নয়ন
  10. তথ্য প্রযুক্তি
  11. নির্বাচন বার্তা
  12. প্রতিবেদন
  13. প্রবাস বার্তা
  14. ফিচার
  15. বাণিজ্য ও অর্থনীতি

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তাঁর রাষ্ট্রটি মর্যাদার সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখুক

হাসান মোরশেদ : ইবার্তা টুয়েন্টিফোর ডটকম
সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

চীন ও আমেরিকা এখন যুযুধান, তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই রাষ্ট্রই কী করে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকায় একসঙ্গে ছিলো? সহজ করে বলা যাক। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর চীন ভারত চরম বৈরী। আমেরিকা চাইলো চীনের বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের সুত্রধর হলো পাকিস্তান, আরো স্পেসিফিকলি পাকিস্তানের তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো। অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ড্যাশিং, স্মার্ট, সোশ্যালিজমের কথা বলা লোক। ভারত সরাসরি আমেরিকা বিরোধী না হলেও সোভিয়েতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেশি। সোভিয়েত-চীন দ্বন্দ্বের পর ঘনিষ্ঠতা আরো বেশি। চীনের তিব্বত দখলের পর তিব্বতী গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেয়ানোতে আমেরিকা ভারতকে সাহায্য করলেও পরে এই প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বকে জোর দেয়। কেননা প্রধান শত্রু সোভিয়েত তখন চীনের শত্রু হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানে ভুট্টোর ঘনিষ্ঠজন আরেক সোশ্যালিস্ট মওলানা ভাসানী। ভুট্টোর উদ্যোগে ১৯৬৩ সালে তিনি চীন ঘুরে এলেন, মাও তাঁকে বিশেষ এক অনুরোধ করলেন। সেই অনুরোধের প্রেক্ষিতে এসে বললেন, ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’। পাকিস্তানের আরেক জাতীয় নেতা সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী আমেরিকাপন্থী বলে পরিচিত হলেও চীনের সঙ্গেও ছিলো তাঁর ঘনিষ্ঠতা। চীনের প্রধানমন্ত্রী প্রথম পাকিস্তান সফর করে গিয়েছিলেন তাঁর দুতিয়ালিতেই। সোহরাওয়ার্দীর পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ ল্যাফটেনেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান আবার জাতীয়তাবাদী, মানে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ই তাঁর লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে যে কারো সহযোগিতাতে তাঁর আপত্তি নেই। নেতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে এ নিয়ে তাঁর মতবিরোধ হলেও তিনি চুপ থাকেন সময়ের অপেক্ষায়। সময় আসে তাঁর ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর। এবার মুজিব শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে তাঁর নিজস্ব রাজনীতি।

১৯৬৬ সালে বোমা ফাটান শেখ মুজিব। ছয়দফা। আইয়ুব খান, ভুট্টো ও চীনের প্রিয়জন মওলানা ভাসানী ছয়দফা প্রত্যাখ্যান করেন সিআইএর এজেন্ডা বলে। সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিও অনেক পরে তাদের মূল পার্টির সিগন্যাল পাওয়ার পর ছয়দফা সমর্থন করে। ১৯৬৬ থেক ১৯৭০ সময়ে শেখ মুজিব নিজেকে কেন্দ্র করে তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলেন, ছয়দফা দাবিকে তুলে দেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁর রাজনৈতিক দলটিতে ভারতপন্থী, সোভিয়েতপন্থী, মার্কিনপন্থী সবই ছিলো। কিন্তু সবাইকেই তিনি ছয়দফা হয়ে ধাপে ধাপে একদফার দিকে ধাবিত করেন। প্রথম নির্বাচন, পরে অসহযোগ আন্দোলন, তারপর মুক্তিযুদ্ধ। চীনপন্থীরা ছয়দফা থেকে বিরোধিতা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিরোধিতাতেই থাকে যদিও এদের বহুধা বিভক্ত গ্রুপগুলোর মধ্যে দু-তিনটি গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা একটা ‘ন্যুইসেন্স’ মাত্র, পাকিস্তানকে মাঝে রেখে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তাদের কাছে জরুরি সোভিয়েতকে মোকাবেলা করতে। পাকিস্তান দুর্বল হওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী তখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তাঁর দলের ভারতপন্থী, সোভিয়েতপন্থী ও মার্কিনপন্থীদের মধ্যে মতানৈক্য ঘটে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি মুক্ত হয়ে এসে যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব নেন তখন তাঁর দলের ভেতরের এই মতাদর্শিক বিভক্তি আরো প্রখর হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য সাহায্য করার জন্য ভারত ও সোভিয়েতের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা ছিলো, মার্কিন ও চীনের প্রতি সমালোচনা ছিলো। কিন্তু যুদ্ধ-বিধ্বস্ত রাষ্ট্র গঠনে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন- এই বাস্তবতা তাঁর জানা ছিলো। একইসঙ্গে তিনি চাচ্ছিলেন না বাংলাদেশকে সোভিয়েত ব্লকে অন্তর্ভুক্ত করতে বা ভারতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হতে। এই অবস্থানে শেখ মুজিবুর রহমান একেবারে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছিলেন তাঁর নিজের দলের মধ্যে। চীনপন্থীরা ভাসানীর নেতৃত্বে সরকারের বাইরে থেকে সরাসরি বিরোধিতা শুরু করেছিলো। সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরাসরি মার্কিন বিরোধিতা শুরু করেছিলেন, মার্কসবাদের কথা বলছিলেন যদিও সোভিয়েত নয় তাঁর নির্ভরতা ছিলো ভারত-মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা থেকে। সরকারের সহযোগী হিসেবে ন্যাপ ও সিপিবি সরাসরি সোভিয়েত ব্লকের রাজনৈতিক দল, এদের চাপ ছিলো সোভিয়েতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার। প্রভাবশালী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ন্যাপ সিপিবির চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলো। মার্কিন বিরোধিতায় তিনিও প্রবল সোচ্চার।

এদিকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে মার্কিন ও ইউরোপীয় সাহায্য নিচ্ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি সকলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছিলেন যাতে মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা না যায়। ভারত সোভিয়েতের পাশাপাশি মার্কিন, চীন, সৌদী আরব সবার সঙ্গেই সুসম্পর্কের চেষ্টা করছিলেন সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েও। এমনকি যখন বাকশাল গঠন করেন তখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন- বাংলাদেশ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হচ্ছে না। নিজের পররাষ্ট্র ভাবনার সঙ্গে রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের মতবিরোধ নিশ্চয় তাঁর জন্য বিব্রতকর ছিলো। প্রশ্ন উঠতে পারে, শীতল যুদ্ধের সে সময়ে কী এরকম নিরপেক্ষ থাকা আদৌ সম্ভব ছিলো? অসম্ভব ছিলো না বলেই তখন নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের জোট গড়ে উঠেছিলো। মিশরের নাসের কিংবা যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং সোশ্যালিস্ট হয়েও জোট নিরপেক্ষ ছিলেন, সতর্ক ছিলেন যেন তাঁরা সোভিয়েত ব্লক ভুক্ত না হন। শেখ মুজিবুর রহমান যেমন মার্শাল টিটোও তেমনি মার্কিন সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। স্ট্যালিনের গুপ্ত ঘাতকদের টার্গেট হয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত। এ প্রশ্নও উঠতে পারে- শেখ মুজিব কি শেষ রক্ষা করতে পেরেছিলেন? তিনি কি মার্কিন পাকিস্তান-চীন অক্ষের হাতেই শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারাননি? এ উত্তর আমরা জানি, ইতিহাস জানে। তবু ইতিহাস সাক্ষী দিবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন তাঁর রাষ্ট্রটি কোন ব্লকের করদ না হয়ে মর্যাদার সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখুক। ইতিহাসের পরিক্রমায় সেই চীন ও আমেরিকা আজ মুখোমুখি। বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিলো যে দুটি বৃহৎ রাষ্ট্র তাদের মধ্যে আজ প্রতিযোগিতাকে এই ‘অতি ক্ষুদ’ রাষ্ট্রটিকে নিজেদের জোটভুক্ত করতে পারে? আমরা কি একে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাশার মেটাফোরিক বাস্তবায়ন হিসেবে ভাবতে পারি? ঝুঁকি আছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মেরুকরণে বাংলাদেশ গুরুত্ব পাচ্ছে- এটা বোধ হয় অস্বীকার করা যাচ্ছে না আর।

লেখক : হাসান মোরশেদ – গবেষক


সর্বশেষ - রাজনীতি