বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং পৃথিবীর ধ্বংসের সম্ভব্য কারণ বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর এই বিশাল জনগোষ্ঠীর শক্তির চাহিদা পূরণ করতে এই পৃথিবী একটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে।’ বর্তমান বাস্তবতায় এই পরিস্থিতির অনেকটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।
মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব আবহাওয়ায় অস্থিরতা চলছে। আবহাওয়া মণ্ডলে গড় তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এই অবস্থায় ২০১৫ সালে প্যারিসে বিশ্বনেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈঠকে বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়ানো যাবে না এই মর্মে চুক্তি সম্পাদিত হয়।
চুক্তির বাস্তব ফলাফল না পেয়ে ২০১৯ সালে ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বের প্রায় ১৮৫টি দেশের কয়েক কোটি তরুণ-তরুণী বিক্ষোভ করে যা ‘ক্লাইমেট স্ট্রাইক (Climate Strike)’ নামে পরিচিত।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো শিল্পবিপ্লবের নামে আবহাওয়া মণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে চলছে। যার প্রভাব আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনাই বর্তমান সময়ে তীব্র গরমে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। জনসংখ্যায় ক্রমবর্ধমান চাপে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। রাজধানী ঢাকার অবস্থা আরও শোচনীয়। কারণে অকারণে বনাঞ্চল ও জলাধার ধ্বংসের কারণে আবহাওয়ার বিরূপ অবস্থায় আমাদের জনজীবন আজ অতিষ্ঠ।
নতুনভাবে জলাধার তৈরি ও বৃক্ষরোপণই পারে এই অবস্থা থেকে আমাদের বাঁচাতে। গাছ বিভিন্নভাবে আবহাওয়ার তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। বায়ুমণ্ডল উত্তপ্তকারী কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস গাছ পাতার মাধ্যমে গ্রহণ করে। ট্রান্সপিরেশন (Transpiration) প্রক্রিয়ায় গাছ কিছু পরিমাণ পানি বের করে দেয়। যা আবহাওয়া ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। গাছের ছায়া অতি গরমের হাত থেকে রক্ষা করে।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ১৯৭২ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় বন্ধ করেন।
১৯৭৩ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭৫ সালে উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণে ও গবেষণার জন্য ন্যাশনাল হার্বেবিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। উনার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
বিশেষ করে ঢাকার জলাধারগুলো সংরক্ষণের জন্য উনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। এছাড়া একজন বৃক্ষপ্রেমিক হিসেবে উনি বৃক্ষরোপণেও বিশেষ গুরুত্ব দেন। সুজলা সুফলা এই দেশ নানা ধরনের গাছগাছালিতে ভরপুর ছিল।
একসময় রাজধানী ঢাকাও ছিল নানা ধরনের গাছপালায় ঢাকা। মানুষ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে ঢাকার বনাঞ্চল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, রমনা, আগারগাঁওসহ সব জায়গায় বনাঞ্চল আজ বিভিন্ন কারণে সংকুচিত হয়ে গেছে।
শহরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করতে গিয়েও কাটা পড়েছে অসংখ্য গাছ। যে পরিমাণ গাছ কাটা পড়েছে সেই পরিমাণ গাছ কিন্তু লাগানো হয়নি। আধুনিক জীবনযাত্রার জন্য যেমন প্রয়োজন নতুন নতুন স্থাপনা তেমনি একই সাথে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ।
ঢাকার সড়কদ্বীপগুলো হতে পারে বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত স্থান। এইসব সড়কদ্বীপে স্থান পেতে পারে দেশীয় ফলজ বা সৌন্দর্যবর্ধনকারী বিভিন্ন উদ্ভিদ। স্থানভেদে গাছ বা ঝোপজাতীয় উদ্ভিদ স্থান পেতে পারে।
ঢাকার দক্ষিণে বিশেষভাবে পুরান ঢাকায় সড়কদ্বীপ প্রশস্ত করে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। সম্প্রতি মেট্রোরেলের নিচে সড়কদ্বীপে ব্ক্ষৃরোপণ করা হচ্ছে। এই সড়কদ্বীপে বিভিন্ন দেশীয় ফলজ ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী উদ্ভিদ স্থান পাবে বলে আশা করি।
সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, সড়কদ্বীপে বনসাই লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বন্ধ করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি বনসাই কোনো অবস্থাতেই সৌন্দর্যবর্ধনকারী হতে পারে না। এরচেয়ে টগর, পলাশ, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, রাধাচূড়া, কবরী, গন্ধরাজ প্রভৃতি উদ্ভিদের মাধ্যমে সড়কদ্বীপে সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে যুক্তিযুক্ত।
এছাড়া ছাদ বাগানে দেশের সব মানুষদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে হবে। পরিশেষে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে আমাদের বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে এবং এর পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করতে হবে।
লেখক: বিভাস কুমার সরকার – সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।