করোনা আক্রান্ত রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় দেওয়া হয় প্লাজমা থেরাপি। শরীরের রক্ত থেকে এক প্রকার রস নিয়ে তা প্রয়োগ করা হয় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে। কিন্তু এই প্লাজমা সংগ্রহের প্রধান শর্ত হলো করোনা থেকে সুস্থ হতে হবে। প্লাজমার চাহিদার তুলনায় দাতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কম হওয়ায় সেখানে ফায়দা নিচ্ছে একশ্রেণির প্রতারক চক্র। দাতা সংগ্রহ করে দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীর স্বজনদের রিকুইজেশন না দিয়ে প্লাজমা সরাসরি হাসপাতাল সংগ্রহ করলে এই প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব।
প্লাজমা থেরাপি কী
যখন কোনও রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তখন তা মানুষের শরীরের রক্তে মিশে থাকে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে রক্তের জলীয় উপাদান প্লাজমায় থাকে। সুনির্দিষ্ট উপায়ে তাকে রক্ত থেকে পৃথক করে ফেলা যায় এবং আরেকজনের শরীরে স্বাভাবিক রক্তের মতো প্রবেশ করানো যায়। এটিই মূলত ‘প্লাজমা থেরাপি’।
কারা প্লাজমা দান করতে পারবেন?
প্লাজমা দানের জন্য শর্ত দুটি। একটি হলো রোগটির জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে হবে, মানে রোগাক্রান্ত হতে হবে এবং তা থেকে সুস্থ হতে হবে। পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার পর জাতীয় গাইডলাইন অনুযায়ী নেগেটিভ হতে হবে প্লাজমা দানকারী ব্যক্তির। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর শারীরিকভাবে পূর্ণ সুস্থ হওয়ার ১৪ দিন পর অথবা আক্রান্ত হওয়ার ২৮ দিন পর একজন ব্যক্তি প্লাজমা দান করতে পারবেন। নারীদের মধ্যে যারা সন্তান জন্মদান করেছেন বা গর্ভবতী হওয়ার পর গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিল তারা প্লাজমা দান করতে পারবেন না। প্রচলিত আইনের আলোকে রক্তের যেসব পরীক্ষা করা হয় তার পূর্ণ নেগেটিভ রিপোর্ট হতে হবে।
প্লাজমা ডোনার খুঁজে দিতে যেভাবে প্রতারণার জাল বিছানো হয়
প্লাজমা ডোনার খোঁজার জন্য সহজ উপায় হিসেবে মানুষ প্রথমেই খোঁজে ফেসবুকে। প্লাজমা ডোনার সন্ধানের জন্য ফেসবুকে বেশ কয়েকটি গ্রুপ আছে। এসব গ্রুপে ওঁৎ পেতে থাকে সুযোগসন্ধানী কিছু ফেসবুক আইডি। তারা পোস্টদাতার দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে বলেন, ব্লাড গ্রুপ অনুযায়ী ডোনার রেডি আছে। ঢাকার ভেতরে রোগী হলে এক্ষেত্রে ‘ডোনার’ থাকে ঢাকার বাইরে। ঢাকার বাইরে থেকে ডোনারকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলে আসতে পারার কথা জানানো হয়। এক্ষেত্রে যাতায়াত খরচ বাবদ ১৫০০-২০০০ টাকা দাবি করেন। সরল বিশ্বাসে মানুষ টাকা পাঠিয়ে দিলেও টাকা পাওয়ার পর মোবাইল হয়ে যায় বন্ধ। ওই কথিত দাতাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে প্লাজমার কথিত দাতার এবং প্লাজমার প্রয়োজন এমন একজন ব্যক্তির কথোপকথন ফেসবুকে পাওয়া যায়। সেই অডিও’র সূত্র ধরে জানা যায়, প্লাজমার প্রয়োজন জানিয়ে কথা বলেন ঢাবির শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ হৃদয়। ডোনার খুঁজে দেওয়ার কথা ওই ব্যক্তি নিজেই ফেসবুকে একটি পোস্টে কমেন্ট করেন। সেখান থেকে নম্বর নিয়ে হৃদয় তাকে ফোন দেন।
কথোপকথন থেকে জানা যায় হৃদয়ের কাছে কথিত প্লাজমা দাতা ওই ব্যক্তি ১ লাখ টাকা দাবি করেন। এই টাকার বিনিময়ে তিনি প্লাজমা ডোনার দিতে রাজি হন। অডিও রেকর্ডে প্লাজমা ডোনার দিতে ইচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘ওনার বি পজিটিভ ব্লাড গ্রুপ, উনি এক লাখ টাকা চায়। সবাই তো আর প্লাজমা দিতে চায় না। উনি রাজি। যে অবস্থা বাংলাদেশের কয়েকদিন পরে ২-৩ লাখ টাকায় পাওয়া যাবে না। প্লাজমা এখন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আরও দুইদিন ওয়েট করেন, ২ লাখ টাকা হয়ে যাবে। লাখ লাখ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে করোনা রোগীর।
কথোপকথনে হৃদয় তাকে জানান যে এখন পর্যন্ত অনেকেই প্লাজমা দিয়েছে কিন্তু এভাবে কেউ টাকা ডিমান্ড করেনি। এরপর ওই ব্যক্তি জানান- টাকা দিতে রাজি হলে প্লাজমা ডোনারের নম্বর দেওয়া হবে। ডোনার তার পরিচিত। তিনি হৃদয়কে রাজি হলে ফোন দিতে বলে কল কেটে দেন।
অডিও রেকর্ডটি গোয়েন্দা সংস্থার নজরে আসার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে তারা। ইতোমধ্যে ওই ব্যক্তির অবস্থান শনাক্ত করা গেছে বলে জানা গেছে। হৃদয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে, এই মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু বলা যাবে না।
ফেসবুকে কয়েকজন প্লাজমার সন্ধান পেতে কয়েকটি পোস্ট দেন বিভিন্ন গ্রুপে। গত ১৭ জুন ০১৮৩১২৬২৩১৭ নম্বর থেকে কয়েকজনকে ফোন দেওয়া হয় প্লাজমা ডোনারের কথা জানিয়ে। কিন্তু ওই নম্বরের ব্যক্তি জানান, রক্ত দিতে হলে টাকা দিতে হবে আগে এবং টাকা পেলে ডোনার আসবে। প্লাজমা প্রাপ্তির ব্যাকুলতায় কয়েকজন প্রথমবার ২ হাজার টাকা এবং পরেরবার ১ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন ওই নম্বরে। টাকা পাওয়ার পর ওই নম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীরা জানান, ওই ব্যক্তি এরকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে একই কাজ করেছে বলে তারা জানতে পারেন। ওই ব্যক্তির নম্বর প্লাজমা সন্ধানের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করে সবাইকে সতর্ক করেছেন তারা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানার পর ওই নম্বরে ফোন দিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে।
প্লাজমা নিয়ে প্রতারণার বিষয়ে চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আশরাফুল হক জানান, গত মাসের দিকে প্লাজমা কেনাবেচার মতো একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এরপর থেকে আমরা বিশেষ কয়েকটি জায়গা থেকে প্লাজমা সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছি। বন্ধ করে দেওয়ার পর ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার এবং বাঁধনসহ একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করিয়েছে। তাদের সঙ্গে আমরা প্লাজমা নিয়ে কাজ করছি। এখন যেহেতু একটি অরগানাইজডভাবে হচ্ছে, আমরা সেটি এখন দেখছি না।
তিনি আরও বলেন, তবে আজকে সকালে আমি একজন চিকিৎসককে পেলাম, যার বাবা বারডেমে চিকিৎসাধীন। তার জন্য একজন ডোনার আসবেন বলেছিলেন, তাকে এ নেগেটিভ প্লাজমা দেওয়ার কথা। ওই ব্যক্তি অগ্রিম টাকা চেয়েছিলেন, টাকা পেলেই আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তাকে যাওয়া আসার ভাড়া বাবদ কিছু টাকা পাঠানো হয়, কিন্তু টাকা পাওয়ার পর ওই ব্যক্তি ফোন বন্ধ করে বসে আছে। ওই চিকিৎসক যখন আমার কাছে এসে প্লাজমার সন্ধান করেন, তখন জানতে পারলাম এখনও ভোগান্তি চলছে।
প্লাজমা চিকিৎসা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাইডলাইন এবং জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির বক্তব্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি গত ২৮ মে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে প্লাজমা থেরাপি না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সুপারিশে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড-১৯ রোগে হাইড্রোক্সি-ক্লোরোকুইন নামক ওষুধ ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ ওষুধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার গাইডলাইনে এ ওষুধ না রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। আইভারমেকটিন, কনাভালোসেন্ট প্লাজমা ও অন্যান্য অননুমোদিত ওষুধ কেবল সুনির্দিষ্টভাবে অনুমোদিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে ব্যবহার না করার সুপারিশ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় এসব ওষুধ বা ব্যবস্থা চিকিৎসা বা প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহার না করার পরামর্শ দিচ্ছে।
করোনা চিকিৎসা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদকৃত ‘জাতীয় কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গাইডলাইনে’ বলা হয়েছে কোন রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া যাবে। সেখানে বলা হয়, রোগীর বয়স ১৮ বছরের উপরে হতে হবে এবং করোনা পজিটিভ হতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন হতে হবে, আক্রান্ত ব্যক্তির বা তার পরিবারের অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া জীবনের জন্য হুমকি হয় এমন কয়েকটি লক্ষণের মধ্যে যেকোনও একটি দেখা দিলে সেসব রোগীকে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া যেতে পারে। লক্ষণসমূহের মধ্যে আছে- তীব্র শ্বাসকষ্ট হলে, প্রতি মিনিটে শ্বাস প্রশ্বাসের মাত্রা (রেস্পেরেটরি রেট) ৩০-এর বেশি হলে, অক্সিজেন মাত্রা ৮৮ শতাংশের কম থাকলে, শ্বাসতন্ত্রের পিএফ অনুপাত ৩০০-এর কম হলে, সেপ্টিক শক কিংবা একাধিক অঙ্গ বিকল হলে।
ডা. মো. আশরাফুল হকের মতে, প্লাজমা যদি সরাসরি হাসপাতাল সংগ্রহ করে তাহলে এই প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমাকে আমার এক আত্মীয়ের জন্য প্লাজমা যখন ব্যবস্থা করতে বলা হলো আমি তো যেকোনও মূল্যে সেটা সংগ্রহের চেষ্টা করবো এটি স্বাভাবিক। আমি যখন সংগ্রহ করার চেষ্টা করবো তখন তো জানবো না কে সৎ কিংবা কে অসৎ। তাই আমি সেভাবেই ম্যানেজ করার চেষ্টা করবো যাতে আমার আত্মীয়কে আমি বাঁচানোর সুযোগ পাই। সেক্ষেত্রে আমার হাতে যখন প্লাজমা সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হবে সেখানে ভোগান্তি হবেই। সামাজিক মাধ্যমসহ নানাভাবে চেষ্টা করার প্রাক্কালে অসৎ মানুষের খপ্পরে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেটা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে যদি কোনও একটা ফোরাম থাকে কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থাকে, যারা প্লাজমা ডোনার খুঁজে দেবে, তাদের সঙ্গে হাসপাতালগুলো একটি চুক্তি করতে পারে। যেখানে আর্থিক লেনদেনের কোনও সুযোগ থাকবে না। সেক্ষেত্রে হাসপাতালের যে প্রক্রিয়া সে অনুযায়ী প্লাজমা সংগ্রহ করা যাবে। এক্ষেত্রে কিন্তু ওই সমস্যা তৈরি হওয়ার সুযোগ আর থাকে না।
আইনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে রক্ত পরিসঞ্চালন আইনের অধীনেই কিন্তু প্লাজমার সবকিছু হবে। এটা রক্তের সব উপাদানের জন্যই বলবৎ।